যে-ছয়জন মানুষ রইসউদ্দিনকে চেপে ধরে রাখার চেষ্টা করছিল তাদের সবার দেখার মতো একটা চেহারা হয়েছে। একজনের বাম চোখটা বুজে এসেছে, একজনের নাক দিয়ে ঝরঝর করে রক্ত পড়ছে। দুজন ন্যাংচাতে ন্যাংচাতে হেঁটে গেল। মোটামতন মানুষটা থু করে থুতু ফেলল, সেখানে তার একটা দাঁত বের হয়ে গেল। শুকনোমতো মানুষটা তার ঘাড় নাড়াতে পারছিল না। চাপদাড়িওয়ালা মানুষটা মাথা নেড়ে বলল, “এই মানুষটা তো দেখি ডেঞ্জারাস মানুষ!”
যে-লোকটার মার খেয়ে একটা দাঁত পড়ে গেছে সে কাঁদোকাঁদো গলায় বলল, “এইরকম মানুষ হলে আমি কোনো অ্যাকশানে নাই।”
যে-মানুষটা ঘাড় নাড়াতে পারছিল না সে পুরো শরীর ঘুরিয়ে বলল, “কোথা থেকে এসেছে এই মোষ?”
“বুঝতে পারছি না। কফিলউদ্দিন আর ফোরকান আলির পার্টি থেকে খোঁজ পেয়েছে মনে হল।”
যে-মানুষটার নাক থেকে ঝরঝর করে রক্ত ঝরছে সে হাতের তালু দিয়ে রক্ত পরিষ্কার করে বলল, “আজেবাজে পার্টির সাথে কাজ করা ঠিক না। কোনদিন কী বিপদ হয়!”
চাপদাড়ি বলল, “এই পার্টি এতদিন তো রিলায়েবল ছিল। গত দুইটা কেস গোলমাল করেছে।”
“এখন কী করবেন ডাক্তার সাহেব?”
“দেখি চিন্তা করে। নিচে অ্যামবুলেন্সটা রেডি রাখতে বলল, এইগুলোকে যদি সরাতে হয় যেন গোলমাল না হয়।”
“জি আচ্ছা।” যে-দুজন ন্যাংচাতে ন্যাংচাতে হেঁটে যাচ্ছিল তাদের একজন রইসউদ্দিনকে দেখিয়ে বলল, “এই পাগল আবার জেগে উঠবে না তো?”
চাপদাড়ি মাথা নাড়ল, “আরে না! এত সহজে উঠবে না।”
“এই লোক যদি জেগে যায় আমি কিন্তু তা হলে ধারেকাছে নাই।”
দাঁত-পড়ে যাওয়া মানুষটা কাঁদোকাঁদো মুখে বলল, “আমিও নাই।”
বাম চোখ বুজে-যাওয়া লোকটা মাথা নেড়ে বলল, “আমিও এর একশো হাতের মাঝে নাই।”
চাপদাড়ি মাথা নেড়ে বলল, “আরে না! ভয় পেয়ো না, এত সহজে এর ঘুম ভাঙবে না। কড়া এনস্থিশিয়া দিয়েছি।”
মানুষগুলো আবার তাদেরকে ঘরে তালা মেরে রেখে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। পায়ের শব্দ মিলিয়ে যাবার পর খোকন ফ্যাসফাস করে একটু কেঁদে ফেলে বলল, “এখন কী হবে?”
বল্টু বলল, “ভয় পাসনে। এই দেখ”
শিউলি অবাক হয়ে দেখল শার্টের নিচে বল্টুর প্যান্টে গোঁজা একটা রিভলবার। একটা চিৎকার দিতে গিয়ে কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে নিচু গলায় বলল, “রিভলবার! কোথায় পেলি?”
“যখন ধস্তাধস্তি করছিলাম তখন সবার পকেট মেরে দিয়েছি।”
“আর কী কী পেয়েছিস?
বল্টু সবকিছু বের করে দেখাল, কুড়ি টাকার নোটের একটা বান্ডিল, ময়লা একটা রুমাল, একটা সিগারেটের প্যাকেট, একটা কালো সানগ্লাস, একপাতা মাথা ধরার ট্যাবলেট, এবং পাগলের তেলের একটা বিজ্ঞাপন।
বল্টু মাথা নেড়ে বলল, “রিভলবার ছাড়া আর কোনো জিনিস কাজে লাগবে না।”
খোকন জিজ্ঞেস করল, “টাকা?”
“এই ঘরের ভেতরে আটকা থাকলে টাকা কী কাজে লাগবে?”
বল্টু চিন্তিতমুখে বলল, “তা ঠিক।”
খোকন মাথা নেড়ে বলল, “এখন কী করবে?”
শিউলি বলল, “রইস চাচাকে যদি ঘুম থেকে তোলা যেত তা হলেই চিন্তা ছিল না। এই রিভলবার নিয়ে একটা হুংকার দিতেন–সবাই ঠাণ্ডা হয়ে যেত!”
বল্টু মাথা নাড়ল, “গাগুর মতো কাপড়ে পিশাব করে দিত।”
ওরা রইসউদ্দিনের কাছে গিয়ে তাঁকে ঘুম থেকে তোলার চেষ্টা করল, কিন্তু। রইসউদ্দিন একেবারে গভীর ঘুমে, ধাক্কাধাক্কি করেও কোনো লাভ হল না। হাল। ছেড়ে দিয়ে বল্টু বলল, “আমাদেরকেই চেষ্টা করতে হবে।”
“কীভাবে?”
“আমি রিভলবারটা হাতে নিয়ে চিৎকার করব, তোমরাও চিৎকার করবে।”
শিউলি বল্টুর দিকে তাকাল, এইটুকুন মানুষ হাতে রিভলবার কেন, একটা মেশিনগান নিয়ে দাঁড়ালেও কেউ তাকে দেখে ভয় পাবে বলে মনে হয় না। কী করা যায় সেটা নিয়ে যখন চিন্তা করছে তখন খোকন বলল, “এক কাজ করলে হয় না?”
“কী কাজ?”
“আমরা কোনোমতে ঠেলেঠুলে রইস চাচাকে দাঁড় করিয়ে রাখি, ভান করি চাচা জেগে আছেন।”
“সেটা করে কী লাভ?”
“দেখ নাই চাচাকে কেমন ভয় পায়।”
“কিন্তু দেখেই বুঝে যাবে!”
“আমি রইস চাচার গলায় কথা বলব। ঐ যে ভেন্টি-কুন্টি না কী যে বলে সেইভাবে!”
শিউলি হঠাৎ করে চমকে উঠল, এটি সত্যি একটি উপায় হতে পারে। খোকনের দিকে তাকিয়ে বলল, “পারবি তুই?”
নিচে শুয়ে থাকা রইসউদ্দিন হঠাৎ কথা বলে উঠলেন, “না পারার কী আছে!”
শিউলি আর বল্টু চমকে উঠল, এক মুহূর্ত লাগে বুঝতে যে আসলে খোকনই কথা বলছে। শিউলি হাততালি দিয়ে বলল, “ফাস্ট ক্লাস!”
পরিকল্পনার প্রথম অংশটা নিয়ে অবিশ্যি খুব সমস্যা হল, ঘুমিয়ে-থাকা একজন মানুষকে দাঁড় করিয়ে রাখাই অসম্ভব, হাতে রিভলবার ধরানোর তো কোনো প্রশ্নই আসে না। খানিকক্ষণ চেষ্টা করের তারা হাল ছেড়ে দিল। বল্টু বলল, “উঁহু। দাঁড় করানো যাবে না।”
শিউলি বলল, “তা হলে বসিয়েই রাখি।”
“ঠিক আছে।”
তিনজন মিলে রইসউদ্দিনকে টেনে ঘরের কোণায় নিয়ে সেখানে তাঁকে কোনোমতে বসিয়ে দেওয়া হল। একটা পা ভাঁজ করে সেখানে একটা হাত রেখে সেই হাতে রিভলবারটা ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হল–ঘুমের মাঝে একটু পরেপরে হাতটি এলিয়ে পড়ে যাচ্ছিল, কাজেই সেটাকে স্থির রাখতে ওদের জান বের হয়ে গেল। তবুও অনেক চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত রইসউদ্দিনকে রিভলবার হাতে বসানো হল, কিন্তু ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আছে দেখে দৃশ্যটাকে বিশ্বাসযোগ্য মনে হল না। বল্টু বলল, “কালো চশমাটা পরিয়ে দিই।”