শিউলি ফিসফিস করে বলল, “পানির ট্যাংকের পেছনে লুকিয়ে যা।”
সাবধানে গুঁড়ি মেরে তারা পানির ট্যাংকের প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল হঠাৎ খোকনের পায়ে লেগে কী-একটা নিচে পড়ে গিয়ে ঝনঝন করে ভেঙে গেল, সাথে সাথে দুটি ছয়-ব্যাটারির টর্চলাইটের উজ্জ্বল আলোতে তাদের চোখ ধাঁধিয়ে যায়। মোটা গলায় একজন বলল, “দাঁড়া, খবরদার নড়বি না।”
শিউলি, বল্টু আর খোকন থমকে দাঁড়িয়ে গেল। মোটা-গলার মানুষটা বলল, “হারামজাদা পোলাটা একলা আসে নাই, দল নিয়ে এসেছে।”
চিকন গলায় আরেকজন সুর করে বলল, “পিপীলিকার পাখা উঠে মরিবার তরে। এই পিপীলিকাঁদের পাখা উঠেছে।”
“ধর শালাদের” বলে লোক দুইজন এসে তাদেরকে ধরে ফেলল। ছুটে যাবার চেষ্টা করে লাভ নেই, হাতে অস্ত্র থাকলে কিছু-একটা বিপদ হতে পারে জেনেও তিনজনেই খানিকক্ষণ হুটোপুটি করল, শেষ পর্যন্ত মানুষগুলো শক্ত করে শার্টের কলার এবং হাতের কবজি ধরে তিনজনকে কাবু করে ফেলল।
শিউলি চিকন গলায় একটা চিৎকার দেবে কি না ভাবছিল তখন মোটা-গলার মানুষটা তাদের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “মুখে একটা টু শব্দ করেছিস তো লাশ ফেলে দেব। ধাক্কা দিয়ে ছাদ থেকে নিচে ফেলে দেব।”
আসলেই লাশ ফেলে দেবে কি না কে জানে, কিন্তু তারা আর কোনো ঝুঁকি নিল না।
দুজন মানুষ মিলে শিউলি বল্টু আর খোকনকে নিচে নামিয়ে এনে বিউটি নার্সিং হোমের নানা দরজা খুলে ছোট একটা ঘরে ধাক্কা মেরে ঢুকিয়ে দিল। ঘরের মেঝেতে এক কোণায় গালে হাত দিয়ে রইসউদ্দিন বসেছিলেন, তাদের দেখে মনে হল খুব বেশি অবাক হলেন না, একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “তোমাদেরকেও ধরে ফেলেছে?
“হ্যাঁ।”
যে-মানুষ দুইজন তাদের তিনজনকে ধরে এনেছে তারা বাইরে থেকে তালা মেরে চলে যাবার পর রইসউদ্দিন নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “এরা একেবারে অর্গানাইজড ক্রিমিনালের দল।”
খোকন শুকনোমুখে জিজ্ঞেস করল,”তার মানে কী?”
“তার মানে এরা কঠিন বদমাইশ।” খোকন কাঁচুমাচু-মুখে বলল, “এখন কী হবে আমাদের?”
রইসউদ্দিন খোকনের মুখের দিকে তাকালেন, বাচ্চাটির জন্যে হঠাৎ তাঁর মায়া হল, মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “তুমি কোন চিন্তা কোরো না।”
“চিন্তা করব না?”
“না। আমি কিছু-একটা ব্যবস্থা করব।”
রইসউদ্দিন কী ব্যবস্থা করবেন খোকন ঠিক জানে না, কিন্তু তাঁর কথায় সে সত্যি সত্যি ভরসা পেল।
রউসউদ্দিন সারা ঘর খুব চিন্তিতভাবে পায়চারি করতে লাগলেন। তাঁর কপালের কাছে খানিকটা কেটে রক্ত পড়ছে, শার্টেরও খানিকটা জায়গা রক্তে ভেজা, তাঁকে দেখে খুব ভয়ংকর দেখাতে থাকে। তিনি কী করবেন কেউ জানে না, কিন্তু কেউ কিছু জিজ্ঞেস করারও সাহস পেল না।
রইসউদ্দিন বেশ খানিকক্ষণ পায়চারি করে শেষ পর্যন্ত দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সেখানে জোরে জোরে কয়েকটা লাথি দিলেন, তারপর হুংকার দিয়ে বললেন, “এই বদমাইশের দল, জানোয়ারের বাচ্চারা, দরজা খোল।”
দরজার লাথির শব্দেই হোক আর তাঁর বাজখাই ধমকের কারণেই হোক খুট করে দরজা খুলে গেল, দরজার অন্যপাশে দুজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে, একটু আগে তারা শিউলিদের ছাদ থেকে ধরে এনেছে। দুজনের মাঝে যে-হালকা পাতলা সে মোটা গলায় বলল, “কী হয়েছে?”
রইসউদ্দিন এগিয়ে গিয়ে কথা নেই বার্তা নেই মানুষটাকে একটা ঘুসি বসিয়ে দিলেন। শক্ত ঘুসি, মানুষটা একেবারে ছিটকে গিয়ে পড়ল। অন্য মানুষটা সাথে সাথে কোমরে গোঁজা একটা জংধরা ছোট রিভলবার বের করে চিৎকার করে বলল, “খবরদার আর কাছে এলে গুলি করে খুলি ফুটো করে দেব।”
রইসউদ্দিন তবু ছুটে গিয়ে সেই মানুষটাকেও একটা রদ্দা লাগতেন, কিন্তু তার আগেই শিউলি, বল্টু আর খোকন রইসউদ্দিনকে জাপটে ধরে ফেলল। মানুষটার মুখের ভঙ্গি দেখে মনে হল সত্যি সত্যি গুলি করে দেবে।
যে-লোকটার মুখে রইসউদ্দিন ঘুসি মেরেছেন সেই মানুষটা মুখে হাত বুলাতে বুলাতে উঠে দাঁড়িয়ে বিচিত্র একটা দৃষ্টিতে রইসউদ্দিনের দিকে তাকিয়ে রইল। হুটোপুটি এবং চিৎকার শুনে ঘরে আরও কয়েকজন মানুষ চলে এসেছে, একজন একটু বয়স্ক, মুখে কাঁচাপাকা চাপদাড়ি। জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে বদি?”
যে-মানুষটা ঘুসি খেয়েছে সে গালে হাত বুলাতে বুলাতে বলল, “বড় তাঁদড় মানুষ। এখনও মারপিট করছে।”
চাপদাড়িওয়ালা মানুষটা দুশ্চিন্তার ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, “এখানে এত হৈচৈ হলে তো মুশকিল! লোকজনের ভিড় জমে যাবে।”
“কী করব ডাক্তার সাহেব, মাথা-খারাপ মানুষ, মারপিট ছাড়া কিছু বোঝে না।”
“ধরো শক্ত করে, একটা ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিই।” বেশ কয়েকজন মানুষ এগিয়ে এল, রইসউদ্দিনকে চেপে ধরা খুব সহজ হল না, তিনি হাত-পা ছুঁড়ে কিল ঘুসি লাথি মেরে মানুষগুলোর সাথে ধস্তাধস্তি করে গেলেন। ছোট ঘর, ধস্তাধস্তির ধাক্কায় শিউলি, বল্টু আর খোকন একেকজন একেকবার একেকদিকে ছিটকে পড়ল। তার মাঝেই তারাও রইসউদ্দিনকে পক্ষ নিয়ে খানিকক্ষণ ধস্তাধস্তি করল কিন্তু লাভ হল না, ছয়জন মানুষ মিলে রইসউদ্দিনকে চেপে ধরে রাখল আর চাপদাড়িওয়ালা ডাক্তার একটা সিরিঞ্জ নিয়ে পুট করে তার হাতে একটা ইনজেকশন ঢুকিয়ে দিল। কিছুক্ষণের মাঝেই রইসউদ্দিন নেতিয়ে পড়লেন, সবাই তখন তাকে ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াল।