রাত সাড়ে দশটার সময় শিউলি হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “রইস চাচার নিশ্চয়ই কোনো বিপদ হয়েছে।”
খোকন কাঁদোকাঁদো গলায় বলল, “এখন কী হবে?”
বল্টু বলল, “আমাদের যেতে হবে।”
শিরিন বানু চোখ কপালে তুলে বললেন, “কী বলছ তোমাদের যেতে হবে?”
“তোমরা গিয়ে কী করবে?”
“দেখি কী করা যায়।”
শিরিন বানু কঠিনমুখে বললেন, “না শিউলি, বড়দের ব্যাপারে তোমরা মাথা ঘামাবে না। তোমরা সেখানে গিয়ে নতুন ঝামেলা তৈরি করা ছাড়া আর কিছু করবে না।”
শিউলি কিছু বলল না, শিরিন বানুর সাথে সোজাসুজি তর্ক করা সম্ভব নয়, বল্টু তাঁকে যে দারোগা আপা ডাকে, তার মাঝে খানিকটা সত্যতা রয়েছে। ঠিক এরকম সময়ে গাগুর নড়াচড়া দেখে কীভাবে জানি শিরিন বানু বুঝে গেলেন তাকে এক্ষুনি বাথরুমে নিয়ে যেতে হবে, তাকে বাথরুম করিয়ে ফিরে এসে দেখলেন ঘর খালি। শিউলি তার মাঝে বল্টু আর খোকনকে নিয়ে বের হয়ে গেছে।
.
রাত সাড়ে দশটা বেজে গেলেও রাস্তায় বেশ লোকজন। শিউলি, বল্টু আর খোকন বাসা থেকে বের হয়ে একটা রিকশা নিয়ে নিল। বিউটি নার্সিং হোমে পৌঁছে দেখতে পেল পুরো বিল্ডিংটা বন্ধ হলেও নার্সিং হোমের বেশ কয়েকটা ঘরে আলো জ্বলছে। শিউলি উপরে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, “রইস চাচা মনে হয় ঐ ঘরগুলো কোনো-একটাতে আছেন।”
খোকন ভয়ে ভয়ে বলল, “তা হলে বের হয়ে আসছেন না কেন?”
“কে জানে, হয়তো বদমাইশগুলো বেঁধে রেখেছে।”
“বেঁধে রেখেছে? বেঁধে রেখেছে কেন?”
“তা তো জানি না, গিয়ে দেখতে হবে।”
“কেমন করে দেখবে শিউলি আপা?”
শিউলি উপরের দিকে তাকিয়ে মাথা চুলকাতে থাকে, বিউটি নার্সিং হোমের মানুষজনের চোখ এড়িয়ে কীভাবে ঘরের ভেতরে দেখা যায় সে চিন্তা করে পেল না। বল্টু পিচিক করে থুতু ফেলে বলল, “আমি দেখে আসি।”
“তুই দেখে আসবি?” শিউলি অবাক হয়ে বলল, “তুই কীভাবে দেখে আসবি?”
“আগে বিল্ডিঙের ছাদে উঠে যাব, তারপর পানির পাইপ বেয়ে কার্নিসে নেমে আসব। কার্নিসে হেঁটে হেঁটে জানালার সামনে এসে দেখব ভিতরে রইস চাচা আছে কি না।”
শিউলি আঁতকে উঠে বলল, “কী? কী বললি? পানির পাইপ বেয়ে নেমে আসবি?”
“হ্যাঁ।”
“ভয় করবে না?”
“আমার ভয় করে না। মনে নাই আমি ঠিক করেছিলাম বড় হয়ে বিখ্যাত চোর হব?”
“তা ঠিক।”
কাজেই কিছুক্ষণের মাঝে দেখা গেল বল্টু সিঁড়ি বেয়ে বিল্ডিঙের ছাদে উঠে গিয়ে কিছুক্ষণের মাঝে পাইপ বেয়ে নামতে শুরু করেছে। বিউটি নার্সিং হোমের কার্নিসে নেমে সে গুঁড়ি মেরে জানালাগুলো দিকে এগিয়ে যায়। নিচে থেকে অন্ধকারে ভালো করে দেখা যাচ্ছিল না, রাস্তা থেকে উপরের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না, রাস্তাঘাটে এখনও লোকজন হাঁটাহাঁটি করছে, সবাই কৌতূহলী হয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে থাকলে বলুর বিপদ হয়ে যাবে।
শিউলি আর খোকন নিঃশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করতে থাকে, মাঝে মাঝে চোখের কোণা দিয়ে উপরে তাকায়। আবছা অন্ধকারে মনে হল বল্টু একটা জানালার সামনে থমকে দাঁড়িয়েছে। ভেতরে তাকাচ্ছে, এমনকি হাত ভিতরে ঢুকিয়ে কিছু-একটা করছে। শিউলির বুক ধুকধুক করতে থাকে, বল্টু নিশ্চয়ই রইস চাচাকে খুঁজে পেয়েছে।
শিউলি বিনা কারণেই গলা নামিয়ে খোকনকে বলল, “চল, ওপরে যাই।”
“ওপরে?”
“হ্যাঁ। রাস্তায় বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে লোকজন সন্দেহ করবে। ছাদে উঠে যাই।”
খোকন ভয়ে ভয়ে বলল, “কিছু হবে না তো?”
“কী আর হবে? বল্টু গেল না!”
শিউলি আর বল্টু সিঁড়ি বেয়ে একেবারে বিল্ডিঙের ছাদে উঠে যায়। ছয়তলা বিল্ডিং, বিউটি নার্সিং হোমটা তিনতলায়। চারতলায় একটা কম্পিউটারের দোকান, পাঁচ আর ছয়তলায় নানারকম অফিস, বেশির ভাগই বন্ধ হয়ে গেছে। নিচের তলাগুলো মোটামুটি আলো-ঝলমল হলেও পাঁচ আর ছয়তলা প্রায় অন্ধকার। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে উঠতে শিউলির ভয় ভয় করতে থাকে। বিল্ডিংটা নিচে থেকে খুব সুন্দর দেখালেও ছাদটা একেবারে জঘন্য, ময়লা আবর্জনায় ভরা। অন্ধকারে হেঁটে হেঁটে শিউলি আর খোকন ছাদের কিনারায় এসে দাঁড়াল। বৃষ্টির পানি যাওয়ার পাইপটা এখানেই রয়েছে, বল্টু এদিক দিয়েই উঠে আসবে।
কিছুক্ষণের মাঝেই বল্টু পাইপ বেয়ে উপরে উঠে এল, যেভাবে তরতর করে পাইপ বেয়ে উঠে এল যে দেখে মনে হল বল্টু বুঝি এভাবেই বিল্ডিঙে ওঠানামা করে। শিউলি বল্টুকে টেনে ছাদে নামিয়ে এনে বলল, “পেয়েছিস রইস চাচাকে?”
“হ্যাঁ।”
“কোথায়?”
“মাঝখানের ছোট ঘরটার মাঝে। খোকন জিজ্ঞেস করল, “বেঁধে রেখেছে নাকি?”
“না।” বল্টু মাথা নেড়ে বলল, “তবে মারধর করেছে মনে হল। কপালে আর পিঠে রক্ত দেখলাম।”
শিউলি জিজ্ঞেস করল, “তোর সাথে কথা হয়েছে?”
“হ্যাঁ। বেশি কথা বলতে পারি নাই, একটা লোক চলে এসেছিল।”
“তোকে দেখেছে লোকটা?”
বল্টু মাথা চুলকে বলল, “মনে হয় দেখেছে।”
“সর্বনাশ!”
কথা শেষ হবার আগেই হঠাৎ খোকন শিউলির হাত চেপে ধরে ফিসফিস করে বলল, “শিউলি আপু!”
“কী হয়েছে?!”
“ঐ দেখো।”
শিউলি এবং বল্টু ঘুরে তাকিয়ে একেবারে জমে গেল। সিঁড়ির মুখে দুইজন বিশাল লোক দাঁড়িয়ে আছে, মানুষগুলোর এক হাতে মনে হল পিস্তল বা ছোরা–অন্ধকারে ভালো করে দেখা যাচ্ছে না, অন্য হাতে টর্চলাইট, সেটা জ্বালিয়ে মনে হল কাউকে খুঁজছে।