আপাকে দেখে বল্টু এবং খোকন ফ্যাকাশে হয়ে গেল, শিউলি কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে খুব খুশি হয়ে যাওয়ার ভান করে বলল, “আসেন আপা আসেন। আসেন আসেন। ভালো আছেন আপা? স্কুলটা ভালো আছে আপা? স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা সব ভালো আছে?”
আপা মাথা নেড়ে বললেন, “হ্যাঁ, আমি ভালো আছি। আমার স্কুলটাও ভালো আছে। ছাত্র-ছাত্রী সবাই ভালো আছে কি না জানি না, তাই খোঁজ নিতে এসেছি।”
আপা বল্টু এবং খোকনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “কী ব্যাপার? স্কুলে আসনি কেন আজ?”
“ইয়ে আপা আমরা খুব একটা ঝামেলায় পড়ে গেলাম ইয়ে মানে সাংঘাতিক ঝামেলা–”
ঠিক এরকম সময় রইসউদ্দিন তাদের ঘরে এসে হাজির হলেন, মতলুব মিয়া তাঁকে খবর দিয়েছে যে বল্টু আর খোকন নিশ্চয়ই কিছু-একটা গোলমাল করেছে, স্কুলের মাস্টারনি আবার বাসায় চলে এসেছেন। রইসউদ্দিনকে দেখে শিরিন বানু মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন, “এই যে রইস সাহেব, কেমন আছেন?”
“ভালো। মানে ইয়ে–কোনো সমস্যা?”
“না না, কোনো সমস্যা নেই। আমার সবচেয়ে ব্রাইট দুজন ছাত্র স্কুলে যায়নি তাই খোঁজ নিতে এসেছিলাম।”
“স্কুলে যায়নি?” রইসউদ্দিন অবাক হয়ে বলু আর খোকনের দিকে তাকালেন। ঠিক এরকম সময় বিছানার নিচে থেকে গাগুর আনন্দধ্বনি শোনা গেল, “গা গা গা গা–”
শিরিন বানু চমকে উঠলেন, “ওটা কিসের শব্দ?”
শিউলি ঢোক গিলে বলল, “খোকন ভেন্টিকুন্টি–”
রইসউদ্দিন শিউলিকে শুদ্ধ করিয়ে দিয়ে বললেন, “ভেন্ট্রিলোকুইজম। আমাদের খোকন একজন এক্সপার্ট ভেন্ট্রিলোকুয়িস্ট, যে-কোনো জায়গায় শব্দ বের করতে পারে।”
“তাই নাকি?”
“হ্যাঁ।”
সত্যি সত্যি বিছানার নিচে আবার স্পষ্ট শোনা গেল, “গা-গা-গা-গা–” বিছানার নিচে গাণ্ড কী দেখে এত আনন্দ পেয়েছে কে জানে? যতক্ষণ আনন্দে থাকবে সমস্যা নেই, রেগে গেলেই বিপদ।
শিরিন বানু খোকনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “করো দেখি আবার।”
“কী করব?”
“কোনো-একটা শব্দ করো।”
আবার বিছানার নিচে থেকে শব্দ বের হয়ে এল। এবার”গু-গু-গু–” শিউলি একটু ঘাবড়ে গেল, মনে হচ্ছে গাগু বিছানার নিচে রেগে যাচ্ছে।
শিরিন বানু মুগ্ধ হয়ে থোকনের দিকে তাকালেন, এইটুকু ছেলে কী চমৎকার ভেন্ট্রিলোকুইজম করছে, স্পষ্ট মনে হচ্ছে শব্দটা আসছে বিছানার নিচে থেকে। রইসউদ্দিন না বললে তিনি নিশ্চয়ই বিছানার নিচে উঁকি দিয়ে দেখতেন।
বিছানার নিচে থেকে আবার ”গু-গু-গু-গু” শব্দ বের হয়ে এল। শিরিন বানু স্পষ্ট দেখলেন শিউলি, বল্টু এবং খোকন তিনজনের মুখে কেমন জানি ভয়ের একটা ছাপ পড়েছে। তার কিছু-একটা সন্দেহ হল, তিনি মাথা ঘুরিয়ে আবার বিছানার নিচে তাকালেন এবং হঠাৎ করে চমকে উঠলেন–একটা ছোট শিশুর হাত দেখা যাচ্ছে। বিছানার নিচে থেকে একটা ন্যাদান্যাদা বাচ্চা গড়িয়ে বের হওয়ার চেষ্টা করছে।
শিরিন বানু রইসউদ্দিনের দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, “রইস সাহেব, খোকন খুব বড় ভেন্ট্রিলোকুয়িস্ট! শুধু বাচ্চার গলার শব্দ নয়–সে একটা আস্ত বাচ্চা তৈরি করে ফেলেছে!”
রইসউদ্দিন হতচকিত হয়ে বললেন, “কী বলছেন আপনি!”
“এই দেখেন” বলে শিরিন বানু বিছানার নিচে থেকে গাবদাগোবদা একটা বাচ্চাকে বের করে আনলেন, বাচ্চাটি তখনও হাত নেড়ে নেড়ে কোনো-একটা জিনিস নিয়ে প্রতিবাদ করে বলছে, গু-গু-গু!”
রইসউদ্দিনের কয়েক সেকেন্ড লাগল ব্যাপারটা বুঝতে–যখন বুঝতে পারলেন তখন কেমন যেন আতঙ্কিত হয়ে শিউলি, বল্টু আর খোকনের দিকে তাকালেন। কাঁপা গলায় বললেন, “কী? এটা কী? কী হচ্ছে এখানে?”
শিউলি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। রইসউদ্দিন তখন হঠাৎ একটা খুব সাহসের কাজ করে ফেললেন, শিউলিকে ধমক দিয়ে বললেন, “কী হচ্ছে এখানে শিউলি?”
শিউলি একেবারে কাঁদোকাঁদো হয়ে গেল, কাঁচুমাচু-মুখে বলল, “আমি গাগুকে আনতে চাইনি রইস চাচা। কিন্তু কফিল চাচা কিডনি কাটার জন্যে এনেছিল, ভয় পেয়ে রেখে দিয়ে পালিয়ে গেল।”
রইসউদ্দিন চমকে উঠে বললেন, “কী? কী বললে?” শিউলি পুরো ঘটনাটা খুলে বলল, “রইসউদ্দিন প্রথমে হতভম্ব এবং তারপর আস্তে আস্তে হঠাৎ রেগে আগুন হয়ে গেলেন। দাঁত কিড়মিড় করে বললেন, “আমি যদি ব্যাটা কফিলউদ্দিন আর ফোরকান আলির মুণ্ডু ছিঁড়ে না ফেলি!”
০৯. বসার ঘরে শিরিন বানু
০৯.
বসার ঘরে শিরিন বানু গাগুকে কোলে নিয়ে বসে আছেন, ছোট বাচ্চা নিয়ে কী করতে হয় তিনি খুব ভালো করে জানেন। বল্টু অবাক হয়ে আবিষ্কার করেছে এতক্ষণ হয়ে গেল গাগু একবারও তাকে ভিজিয়ে দেয়নি। রইসউদ্দিন সন্ধ্যে
সাতটার সময় বিউটি নার্সিং হোমটাকে দেখার জন্যে বের হয়ে গেছেন, যাবার আগে বলেছেন কিছুক্ষণের মাঝেই চলে আসবেন। ফোরকান আলির পকেটের সব কাগজপত্র অনেকক্ষণ ধরে পরীক্ষা করেছেন, সেখানে নাকি নানা এলাকার মা বাবা নেই সেরকম ছেলেমেয়ের নাম-ঠিকানা লেখা। কোন বাচ্চাকে কত টাকায় বিক্রি করা হবে সেগুলোও লেখা রয়েছে। বিউটি নার্সিং হোমের কয়েকজন ডাক্তারের নাম লেখা আছে, তাদেরকে কাকে কত দিতে হয় তাও লেখা আছে।
রইসউদ্দিন বলে গেছেন কিছুক্ষণের মাঝে ফিরে আসবেন, কিন্তু তিন ঘণ্টা হলে গেল এখনও তার দেখা নেই। শিরিন বানু বেশ চিন্তিত হয়ে গেছেন, কী করবেন ঠিক বুঝতে পারছেন না। শিউলির কেমন জানি ভয় লাগতে শুরু করেছে, বল্টু আর খোকনও একটু পরেপরে জানালার কাছে গিয়ে দেখছে রইসউদ্দিনকে দেখা যায় কি না। শুধুমাত্র গাগু এবং মতলুব মিয়ার কোনোরকম দুশ্চিন্তা হচ্ছে না। গাণ্ড শিরিন বানুর কোলে বসে তার নাকটা কামড়ানোর চেষ্টা করছে, মতলুব মিয়া কয়েকবার হাই তুলে ঘুমাতে চলে গিয়েছে।