সেদিন গভীর রাতে রইসউদ্দিন হঠাৎ চমকে ঘুম থেকে জেগে উঠলেন, শুনলেন শিউলি বল্টু আর খোকনের ঘর থেকে ছোট বাচ্চার কান্নার আওয়াজ আসছে, একা একা থেকে তিনজন বাচ্চার কোনো-একজন মন-খারাপ কান্নাকাটি করলে তিনি এমন কিছু অবাক হতেন না। কিন্তু এটি একেবারে ছোট শিশুর কান্না। রইসউদ্দিন হন্তদন্ত হয়ে বিছানা থেকে নেমে বাচ্চাদের ঘরে এলেন, অবাক হয়ে দেখলেন এত রাতেও তিনজনই জেগে আছে। জিজ্ঞেস করলেন, “ছোট বাচ্চা কাঁদছে কোথা থেকে?”
শিউলি বলল, “খোকন।”
“খোকন?”
“হ্যাঁ।”
শিউলি বলল, “খোকন ভেন্টি-কুন্টি না কী যেন সেইটা প্র্যাকটিস করছে।”
“ভেন্ট্রিলোকুইজম?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ।” শিউলি খোকন আর বল্টু একসাথে জোরে জোরে মাথা নাড়তে শুরু করল।
“এতে রাতে ভেন্ট্রিলোকুইজম?”
খোকন মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, “দিনের বেলা সময় পাই না তো–তাই রাত্রের বেলা প্র্যাকটিস করি।”
রইসউদ্দিন একবার ভাবলেন জিজ্ঞেস করবেন কেন এত রাতে ছোট বাচ্চার কান্না ভেন্ট্রিলোকুইজম দিয়ে প্র্যাকটিস করতে হবে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞেস করলেন না। বাচ্চাকাচ্চা সম্পর্কে তিনি আগেও বেশি জানতেন না, গত কয়েকমাস থেকে এই তিনজনকে একসাথে দেখে যেটুকু জানতেন সেটা নিয়েও নিজের ভিতরে সন্দেহ হতে শুরু করেছে।
রইসউদ্দিন বিছানায় শোওয়ার জন্যে ফিরে গেলেন এবং সারারাত একটু পরেপরে খোকনের ছোট বাচ্চার কান্নার শব্দের ভেন্ট্রিলোকুইজম শুনে চমকে চমকে জেগে উঠতে লাগলেন।
ভোরবেলা রইসউদ্দিন অফিসে চলে যাবার পর শিউলি মতলুব মিয়াকে রান্নাঘরে ব্যস্ত রাখল তখন খোকন আর বল্টু মিলে ছোট বাচ্চাটাকে নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেল। আগে থেকে ঠিক করে রাখা হয়েছে শিউলি যতক্ষণ স্কুলে থাকবে ততক্ষণ বল্টু আর খোকন মিলে বাচ্চাটিকে দেখেশুনে রাখবে। বাসার ভেতরে থাকলে চঁচামেচি কান্নাকাটি করতে পারে বলে এই ব্যবস্থা।
স্কুলে যতক্ষণ থাকল আজ শিউলি খুব আনমনা হয়ে থাকল, বাচ্চাটির জন্যে মনটা খুব নরম হয়ে আছে। এইটুকুন একটা বাচ্চা, সারা পৃথিবী তাকে দেখে রাখার কোনো মানুষ নেই, তাদের মতো তিনজনকে তাকে দেখে রাখতে হচ্ছে ব্যাপারটা চিন্তা করেই তার কেন জানি মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। কতদিন বাচ্চাটিকে লুকিয়ে রাখতে পারবে কে জানে–একটা ছোট মারবেলকে লুকিয়ে রাখা যায়, কিন্তু একটা মানুষকে কি লুকিয়ে রাখা যায়?
স্কুল ছুটির পর শিউলি বাইরে বের হয়ে এসে দেখে বল্টু আর খোকন ছোট বাচ্চাটিকে নিয়ে তার জন্যে অপেক্ষা করছে। বাচ্চাটিকে খোকন তার ঘাড়ে বসিয়ে নিয়েছে এবং সে মহা আনন্দে তার মাথায় চুল দুই হাতে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। শিউলি জিজ্ঞেস করল, “কোনো সমস্যা হয় নাই তো?”
বল্টু মাথা নেড়ে বলল, “হয় নাই আবার!”
শিউলি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”
বল্টু শিউরে উঠে বলল, “আমি ঘাড়ে করে বাচ্চাটাকে নিয়ে যাচ্ছি হঠাৎ মনে হল গরম কী যেন ঘাড়ের মাঝে থেকে শরীরের মাঝে কিলবিল করে ঢুকে যাচ্ছে। আমি ভাবলাম কী না কী হঠাৎ দেখি বাচ্চার পিশাব! সর্বনাশ!”
শিউলি খিকখিক করে হেসে বলল, “এইটা আবার এমন কী ব্যাপার! ছোট বাচ্চা মানুষ করতে হলে এটা সহ্য করতে হবে।”
খোকন বলল, “শিউলি আপু, আমি এর নাম দিয়েছি গাণ্ড।”
“গাগু?”
“হ্যাঁ। যখন তার মনে আনন্দ হয় সে বলে গা-গা-গা–আর যখনই রেগে যায় তখন বলে গু গু গু তাই নাম হচ্ছে গাগু। ভালো হয়েছে না নামটা?”
বল্টু বিরসমুখে বলল, “কচু হয়েছে। গাগু একটা নাম হল? একটা ছেলের নাম কখনো গাগু হয়?”
শিউলি অবাক হয়ে বলল, “ছেলে? ছেলে কোথায় পেলি? জানিস না এটা মেয়ে?”
“মেয়ে নাকি?”
বল্টু মনে হল ভয় পেয়ে দুই পা সরে গিয়ে বলল, “সর্বনাশ!”
শিউলি চোখ পাকিয়ে বলল, “সর্বনাশ? তুই মেয়ের মাঝে সর্বনাশের কী দেখলি?”
বল্টু পিচিক করে থুতু ফেলে বলল, “মেয়ে মানেই সর্বনাশ! আর সেই মেয়ে যদি ছোট হয় তা হলে সাড়ে সর্বনাশ!”
শিউলি বাচ্চাটিকে নিজের কোলে নিয়ে বলল, “এত লক্ষ্মী একটা মেয়েকে তুই সাড়ে সর্বনাশ বলিস, এমন দাবড়ানি দেব যে নিজের নাম ভুলে যাবি!”
শিউলির পক্ষে সেটা সত্যিই সম্ভব তাই বল্টু আর কোনো কথা বলল না। বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে তিনজনে হাঁটতে থাকে, খোকন হাঁটতে হাঁটতে বলল, “গাগুকে সব উলটাপালটা জিনিস শিখাচ্ছি।”
“উলটাপালটা?” “হ্যাঁ। হাতকে দেখিয়ে বলেছি পা, পা-কে দেখিয়ে বলেছি হাত। নাককে দেখিয়ে বলেছি পেট, পেটকে দেখিয়ে বলেছি চোখ। গাগু যখন বড় হবে সবকিছু উলটাপালটা বলবে, মজা হবে না?”
শিউলি একটু অবাক হয়ে বলল, “মজা? কোন জায়গাটায় মজা?”
“যেমন মনে করো যখন রেগে উঠবে তখন খিলখিল করে হাসবে, আর যখন খুব হাসি পাবে তখন ভেউভেউ করে কাঁদবে! সবকিছু উলটাপালটা শিখিয়ে দেব।”
শিউলি মাথা নেড়ে বলল, “খোকন তুই যখন বড় হবি তখন খবরদার বিয়ে করবি না। আর যদি বিয়ে করিস খবরদার যেন বাচ্চাকাচ্চা না হয়। হলে অনেক বিপদ আছে।”
বল্টু পিচিক করে আবার থুতু ফেলে বলল, “বিপদ হবে আমাদের।”
“কী বিপদ?”
“গাগুর জন্যে আজকে স্কুলে যেতে পারলাম না, সন্ধ্যেবেলা দারোগা আপা না আবার বাসায় এসে যায়!”
.
সন্ধ্যেবেলা সত্যি সত্যি দারোগা আপা এসে হাজির হয়ে গেলেন। তখন শিউলি, বল্টু আর খোকন মাত্র গাগুকে খানিকটা দুধ খাইয়ে বিছানার নিচে শুইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে।