কফিলউদ্দিন একেবারে ভয়ে চিৎকার করে উঠলেন। কাঁপা গলায় বললেন, “এই বাচ্চা দেখি কথা বলে!”
ছোট বাচ্চাটা হাতের লজেন্সটা একবার চেটে বলল, “কথা বলব না কেন? একশোবার বলব।”
কফিলউদ্দিন হঠাৎ ভয় পেয়ে বাচ্চাটাকে ফোরকান আলির কোলে বসিয়ে দিল। বাচ্চাটা ফোরকান আলির দিকে তাকিয়ে বলল, “ই ফোরকাইন্যা!”
“এ্যাঁ!” ফোরকান আলি ভয় পেয়ে বলল, “কী বলে এই ছেলে?” বাচ্চাটা স্পষ্ট গলায় বলল, “এক চড়ে দাঁত ফেলে দেব।”
ফোরকান আলি যেন কোলে একটা বিষাক্ত সাপ নিয়ে বসে আছে এরকম ভান করে বাচ্চাটাকে প্রায় ঠেলে নিচে বসিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। ছোট বাচ্চাটা এদিক-সেদিক তাকিয়ে বলল, “শালা কফিলউদ্দিন আর ব্যাটা ফোরকাইন্যা তোরা ভেবেছিস আমি কিছু বুঝি না?”
“তু-তু তুমি কী বলছ?”
“আমি ঠিকই বলছি। পুলিশ আসুক তখন বুঝবে ঠ্যালা!”
কফিলউদ্দিন প্রায় ফ্যাকাশে-মুখে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আমি এর মাঝে নাই, গেলাম আমি, গেলাম। তারপর ফোরকান আলিকে কিছু বলতে না দিয়ে প্রায় ঝড়ের মতো ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
“দাঁড়ান, দাঁড়ান কফিল ভাই–”বলে পেছনে পেছনে ছুটে গেল ফোরকান আলি এবং দেখা গেল দুজনে সিঁড়ি বেয়ে দুদ্দাড় করে নেমে যাচ্ছে। বল্টু আর খোকন কী করবে বুঝতে পারল না, এরকম কিছু-একটা যে হতে পারে সেটা তারা একবারও চিন্তা করেনি। বাচ্চটিকে রেখে যাবে, না সাথে নিয়ে যাবে চিন্তা করে না পেয়ে বল্টু বাচ্চাটাকে ধরে ঘর থেকে বের হয়ে এল। সিঁড়ির কাছে শিউলি দাঁড়িয়ে ছিল, সে কাছে এসে অবাক হয়ে বলল, “কী হল? দুইজন এইভাবে দৌড়ে কোথায় পালিয়ে গেল?”
খোকন খিকখিক করে হেসে বলল, “ভয় পেয়ে পালিয়ে গেছে।”
“কী দেখে ভয় পেয়েছে?”
বল্টু কোনোমতে পেটের সাথে ধরে রাখা নাদুসনুদুস বাচ্চাকে দেখিয়ে বলল, “এই বাচ্চাকে দেখে! কফিলউদ্দিন আর ফোরকান আলিকে এমন ধোলাই দিয়েছে যে দুইজন ভয়ে একেবারে চিমশি মেরে গেছে!”
“ধোলাই?”
খোকন আবার খিকখিক করে হেসে বলল, “আমি এর মুখ দিয়ে কথা বলিয়েছি।”
“কিন্তু এখন এই বাচ্চাটাকে নিয়ে আমরা কী করব?”
”আমি জানি না” বলে খোকন শিউলির কাছে বাচ্চাটাকে ধরিয়ে দিল।
বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে শিউলি বলল, “ইশ, কী গাবদা-গোবদা বাচ্চাটা! দেখে কী মায়া লাগে!
বল্টু ভুরু-কুঁচকে বলল, “কী বলছ! মায়া লাগে? যদি পিশাব করে দেয়?”
“বাজে কথা বলবি না। তোর ধারণা, ছোট বাচ্চা হলেই সে পেশাব করে দেয়?”
শিউলির কথা শেষ হবার আগেই ঝিরঝির করে একটা শব্দ হল এবং মনে হল শিউলিকে সবার সামনে অপদস্থ করার জন্যেই বাচ্চাটি তাকে ভিজিয়ে দিয়েছে।
খোকন হিহি করে হেসে বলল, “ছোট বাচ্চাদের পুরা সিস্টেম উলটাপালটা।”
শিউলি চোখ পাকিয়ে থোকনের দিকে তাকাল, তারপর বাচ্চাটিকে হাত বদলে সাবধানে ধরে রেখে বলল, “এখন একে কী করব?”
বল্টু আবার বলল, “আমি জানি না। আমাকে পকেট খালি করে আনতে বলেছ খালি করে এনেছি। ব্যাটার পকেটে কোনো টাকা-পয়সা নাই, খালি কাগজপত্র। বাচ্চাকাচ্চা কী করবে আমি জানি না।
খোকন বলল, “এই বাচ্চাটাকে বাসায় নিয়ে যাই। রইস চাচা যদি আমাদের তিনজনকে রাখতে পারে তা হলে আর একজন বেশি হলে ক্ষতি কী?
বল্টু মাথা নেড়ে বলল, “একটা ছোট বাচ্চা দশজন বড় মানুষের সমান।”
“কেন?”
“একজন বড় মানুষ কি কখনো ঘরের মাঝখানে পিশাব করবে? করবে না–কিন্তু এই বাচ্চা করে দেবে। একজন বড় মানুষ কি সারারাত গলা ফাটিয়ে চিল্লাবে? চিল্লাবে না–কিন্তু এই বাচ্চা চিল্লাবে। কোনো মানুষকে পছন্দ না হলে একজন বড় মানুষ আরেকজন বড় মানুষের মুখে খামচি মারবে? মারবে না–কিন্তু এই বাচ্চা মারবে।”
“হয়েছে হয়েছে, অনেক হয়েছে।” শিউলি মুখ-ভেংচে বলল, “এখন বোলচাল থামা।”
খোকন আবার বলল, “নিয়ে যাই-না এইটাকে বাসায়। দেখো, কী সুন্দর! একেবারে পুতুলের মতন।”
শিউলি মাথা নাড়ল, “উঁহু। নেয়া যাবে না।”
“কেন নেয়া যাবে না?”
“রইস চাচা বলেছে, আর নতুন কোনো বাচ্চা আমদানি করা যাবে না।”
ছোট বাচ্চাটাকে বগলে চেপে ধরে শিউলি হাঁটতে থাকে। বগলে চেপে ধরে রাখার এই ভঙ্গিটা মনে হল বাচ্চাটারও খুব পছন্দ হল, সে হঠাৎ তার ফোকলা দাঁত বের করে ফিক করে হেসে দিল। সেই হাসিটা এতই মধুর যে দেখে বল্টু পর্যন্ত নরম হয়ে পড়ল, বলল, “শিউলি আপু, চলো এইটাকে বাসায় নিয়ে যাই। একটা ছোট বাচ্চা আর কতটুকু জায়গা নেবে?”
খোকন বলল, “আর কতই-বা খাবে!”
বল্টু বলল, “আমরা নাহয় লুকিয়ে রাখব, রইস চাচা টেরই পাবে না।”
“যখন চাচাবে?”
“তখন বলল খোকন তার ভেন্টি-কুন্টি না কী যেন সেইটা প্র্যাকটিস করছে।”
শিউলি বলল, “একটা ইঁদুরের বাচ্চা, না হলে চড়ুই পাখি বাচ্চা লুকিয়ে রাখা যায়–তাই বলে আস্ত একটা মানুষের বাচ্চা?”
“কিন্তু তুমি করবেটা কী? এই বাচ্চাটাকে রাস্তায় ফেলে দেবে? তার চেয়ে চলো একবার বাসায় রাখার চেষ্টা করে দেখি।”
শিউলি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “ঠিক আছে, চল দেখি।” বাচ্চাটাকে লুকিয়ে রাখার বুদ্ধিটা যে তার খুব পছন্দ হল তা নয়, কিন্তু তার আর কিছু করার ছিল না।
তিনজন যখন বাচ্চাটাকে নিয়ে বাসায় পৌঁছাল তখনও রইসউদ্দিন বাসায় পৌঁছাননি। বল্টু মতলুব মিয়াকে রান্নাঘরে ব্যস্ত রাখল, সেই ফাঁকে শিউলি আর খোকন লুকিয়ে বাচ্চাটাকে তাদের নিজেদের ঘরে নিয়ে গেল। বাচ্চাদের ঘুমানোর এবং জেগে থাকার বিচিত্র সময় রয়েছে, বিকেলবেলা যখন ছুটোছুটি হৈচৈ করার সময় তখন বাচ্চাটি ঘুমিয়ে একেবারে কাদা হয়ে গেল। বাচ্চাটাকে কোথায় লুকানো যায় বুঝতে না পেরে শিউলি আর খোকন তাকে বিছানার নিচে ছোট একটা বিছানা তৈরি করে সেখানে ঘুম পাড়িয়ে রাখল। ঘুম থেকে উঠে বাচ্চাটা নিশ্চয়ই খেতে চাইবে, তখন তাকে কী খাওয়াবে এবং কেমন করে খাওয়াবে সেটা নিয়ে শিউলি খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। ছোট বাচ্চারা কী খায় সেটা তারা ভালো করে জানে পর্যন্ত না। বল্টু আর খোকন মিলে এক গ্লাস দুধ আর খানিকটা ভাত চুরি করে সরিয়ে রাখল, বাচ্চাটা যখন খেতে চাইবে তখন তাই তাকে খাওয়ানো যাবে।