শিউলি হিহি করে হেসে বলল, “দূর গাধা, ডড নং না, এটা হচ্ছে ৬৬ নং।”
বল্টু একটু লজ্জা পেয়ে বলল, “তাই বলো! আমি আরও ভাবছি ডড নং কী!”
খোকন গয়নার দোকানের পাশে একটা মিষ্টির দোকানের সাইনবোর্ড পড়তে শুরু করেছে, হঠাৎ শিউলি চমকে উঠে বল্টর পিছনে লুকিয়ে গেল। বল্টু অবাক হয়ে বলল, “কী হয়েছে শিউলি আপু?”
শিউলি ফিসফিস করে বলল, “চুপ কর গাধা, কথা বলবি না।”
“কেন?”
“ঐ যে দূরে দুইজন লোক, একজন ছাগলদাড়ি আর নীল পাঞ্জাবি ঐ লোকগুলোকে আমি চিনি। বুড়াটার নাম মোল্লা কফিলউদ্দিন।”
“একজনের কোলে যে একটা বাচ্চা, সেই লোকটা?”
“হ্যাঁ। আর তার পাশে যে লোকটা তার নাম ফোরকান আলি। মহা বদমাইশ লোক। কিডনি-ব্যাপারী।”
“কিডনী-ব্যাপারী? সেটা আবার কী?”
শিউলি অধৈর্য হয়ে বলল, “তুই বুঝবি না। চুপ করে দেখ কোনদিকে যায়।”
বল্টু আর খোকনের পিছনে শিউলি নিজেকে আড়াল করে রাখল, তারা দেখল ছোট একটা বাচ্চাকে কোলে নিয়ে মোল্লা কফিলউদ্দিন আর ফোরকান আলি রাস্তা পায় হয়ে অন্য পাশে চলে গেল। দূর থেকে শিউলি বল্টু আর খোকনকে নিয়ে তাদের লক্ষ করতে থাকে। ফোরকান আলি কফিলউদ্দিনকে কিছু-একটা বলল, তারপর দুজন মিলে হনহন করে হাঁটতে থাকে। শিউলি ফিসফিস করে বল্টু আর খোকনকে বলল, “চল পিছুপিছু, দেখি কোথায় যায়।”
বড় রাস্তা পার হয়ে তারা একটা ছোট রাস্তা পার হল, সেখান থেকে আবার একটা রাস্তা, সেখানে বড় একটা দালানের সামনে দাঁড়িয়ে গেল। শিউলি দেখল দালানটির মাঝামাঝি এক জায়গায় একটা বড় সাইনবোর্ড, সেখানে লেখা ‘বিউটি নার্সিং হোম।
কফিলউদ্দিন আর ফোরকান আলি বেশ দূরে, শিউলির কথা শোনার কোনো আশঙ্কা নেই, তবুও শিউলি গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, “এইখানে নিশ্চয়ই কিডনি বিক্রি হয়।”
বল্টু আবার জিজ্ঞেস করল, “কিডনি জিনিসটা কী?”
“তুই বুঝবি না গাধা।”
“এখন কী করবে?”
“দেখি কী করা যায়।”
কফিলউদ্দিন আর ফোরকান আলি দুজনে নিজেদের মধ্যে কিছু-একটা বলাবলি করে ভেতরে ঢুকে গেল। শিউলি খুব চিন্তিতমুখে বলল, “বিপদ হয়ে গেল!”
“কী বিপদ?”
“কফিল চাচা আর ঐ মানুষটা মনে হয় বাচ্চাটাকে এনেছে তার কিডনি কেটে ফেলার জন্যে।”
“কিন্তু কিডনিটা কী জিনিস?”
”তুই বুঝবি না গাধা।”
বল্টু বিরক্ত হয়ে বলল, “বলেই দেখো না বুঝি কি না।”
“শরীরের ভেতরে থাকে। কলিজার মতন। অনেক দামে বিক্রি হয়।”
খোকন মুখ বিকৃত করে বলল, “যাহ্!”
“খোদার কসম। রইস চাচা আমাকে না বাঁচালে কফিল চাচা এতদিনে আমার কিডনি বিক্রি করে ফেলত।”
“সত্যি?”
“সত্যি।” শিউলি তখন দুএক কথায় তার কিডনি বিক্রি করার ঘটনাটা বলার চেষ্টা করল।
বল্টু ঠোঁট কামড়ে বলল, “তুমি বলছ এই বাচ্চাটার কিডনি এখন কেটে ফেলবে?”
“মনে হয়।”
“সর্বনাশ! তা হলে তো কিছু-একটা করতে হবে।”
“চল আগে আমরাও ভেতরে ঢুকি।”
“চলো।”
তিনজনে খুব সাবধানে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে তিনতলায় বিউটি নার্সিং হোমে হাজির হল। কাঁচের দরজা দিয়ে দেখা গেল ভেতরে একটা ওয়েটিংরুমের মতো, সেখানে একটা সোফায় কফিলউদ্দিন আর ফোরকান আলি বসে আছে। কফিলউদ্দিনের কোলে ছোট বাচ্চাটা। তার হাতে একটা লজেন্স ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে, সে খুব মনোযোগ দিয়ে সেটা চাটছে।
শিউলি গলা নামিয়ে বল্টুকে বলল, “তুই একটা কাজ করতে পারবি?”
“কী কাজ?”
“এই দুইজনের পকেট মেরে যা যা কাগজপত্র আছে সবকিছু নিয়ে আসতে পারবি?”
“না।”
“না কেন?”
“পীরের তাবিজ না হলে আমি পারব না। শরীরবন্ধন ছাড়া যাওয়া ঠিক না।”
“ধুর, গাধা, তাবিজ ছাড়াও শরীরবন্ধন হয়।”
“মক্কেল বসে আছে, এইরকম কেস কঠিন–মনোযোগ অন্য জায়গায় না থাকলে করা ঠিক না।”
খোকন দুজনের কথা শুনছিল, বলল, “যদি মনোযোগ অন্য জায়গায় দেওয়া যায়?”
“কীভাবে দিবি?”
“মনে করো আমি আর বল্টু ভাই ভেতরে গেলাম, দুজন বসে নিজেদের ভেতরে কথা বলছি তখন হঠাৎ যদি ছোট বাচ্চাটা কথা বলে ওঠে?”
শিউলি মাথা নাড়ল, “এত ছোট বাচ্চা কথা বলবে কেন?”
“আসলে তো আমি বলব। মুরগিকে দিয়ে কথা বলিয়ে দিয়েছি, এইটা তো সোজা_”
শিউলির চোখ হঠাৎ জ্বলজ্বল করে উঠল, হাতে কিল দিয়ে বলল, “ফাস্ট ক্লাস আইডিয়া! বাচ্চাটা কথা বললেই কফিল চাচা আর ফোরকান আলি একেবারে সাংঘাতিক অবাক হয়ে যাবে, পুরো মনোযোগ থাকবে বাচ্চার দিকে।
বল্টু খুব চিন্তিত মুখে বলল, “দেখি চেষ্টা করে। আল্লাহ মেহেরবান।”
বল্টু কোনো-একটা দোয়া পড়ে বুকে ফুঁ দিয়ে ভেতরে ঢুকল, পেছনে পেছনে খোকন। তাদের দুজনকে দেখে কফিলউদ্দিন আর ফোরকান আলি সরুচোখে তাদের দিকে তাকাল। কোনো একটা-কিছু নিয়ে কথা বলা দরকার তাই বল্টু বলল, “আমাদেরকে এখানে আসতে বলেছেন না?”
খোকন মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ। এইখানে।”
“কয়টার সময় জানি আসবে?”
“পাঁচটার সময়।”
“তা হলে এখনও যে আসছে না?”
“মনে হয় জ্যামে পড়েছে।”
“ও।”
কফিলউদ্দিন আর ফোরকান আলি এই দুইজনের কথাবার্তা শুনে একটু সহজ হল, কেউ-একজন ছেলে দুজনকে এখানে এসে অপেক্ষা করতে বলেছে, এই নার্সিং হোমে সেটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার।
ফোরকান আলির পাশে বসল বল্টু, তার পাশে খোকন। সেখানে বসেও তারা নিজেদের মাঝে কথা বলতে শুরু করে, তখন কফিলউদ্দিন আর ফোরকান আলিও নিচুগলায় কথা বলতে থাকে। হঠাৎ একটা বিচিত্র জিনিস ঘটল, ছোট তিন-চার মাসের বাচ্চাটা হাত নেড়ে বলল, “এই শালা কফিলউদ্দিন!”