এরপর বেশ কিছুদিন কেটে গেছে, রইসউদ্দিন মোল্লা কফিলউদ্দিনের চিঠির কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলেন। তখন আবার তার কাছ থেকে একটা চিঠি এসে হাজির হল। চিঠিতে মোটামুটি একই জিনিস লেখা তবে এবারে শিউলি নামের মেয়েটার কাজকর্মের কিছু বৃত্তান্ত দেওয়া আছে (টুপির মাঝে বিষপিপড়া ছেড়ে দেওয়া, মক্তবের মৌলবি সাহেবকে ভূত সেজে ভয় দেখানো, গ্রামের চেয়ারম্যানের নামে কুকুর পোষা, পাড়ার ছেলেপিলে নিয়ে মাঝরাতে গাবগাছে উঠে বসে থাকা ইত্যাদি ইত্যাদি।) পুরো চিঠিটা পড়ে রইসউদ্দিনের শরীর শিউরে উঠল। চিঠির শেষদিকে এবারে মোল্লা কফিলউদ্দিন বি, এ, বি, টি. কিছু-কিছু কঠিন শব্দ ব্যবহার করেছেন, শুধু তাই নয়, যদি শিউলি নামের মেয়েটাকে এখনই নিয়ে যান তা হলে কোর্টে কেস করে দেবেন বলে ভয় দেখিয়েছেন।
চিঠি পেয়ে রইসউদ্দিন খুব ঘাবড়ে গেলেন। পরদিন অফিস কামাই করে পিয়নের সাথে কথা বললেন। পিয়ন বলল, চিঠিতে যে-রাইচউদ্দিনের ঠিকানা দেওয়া হয়েছে সেখানে কেউ থাকে না বলে তাঁকে চিঠিটা দেওয়া হচ্ছে। রইসউদ্দিন তখন নিজেই খোঁজ-খবর করে প্রকৃত রাইচউদ্দিনকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করলেন, কিন্তু কোনো লাভ হল না। রইসউদ্দিনের ভয় হতে লাগল যে মোল্লা কফিলউদ্দিন বি. এ. বি. টি. হয়তো ‘শিউলি’ নামের ভয়ংকর মেয়েটাকে নিয়ে নিজেই হাজির হয়ে যাবেন। রাতে তাঁর ভালো ঘুম হল না, স্বপ্নে দেখলেন শিউলি নামের মেয়েটা মুখে রং মেখে এসে তার গলা চেপে ধরে খিলখিল করে হাসছে আর হাসির শব্দের সাথে সাথে মুখ দিয়ে আগুন আর নাক দিয়ে ধোঁয়া বের হয়ে আসছে। রইসউদ্দিনের খাওয়ার রুচি নষ্ট হয়ে গেল। কী করবেন বুঝতে না পেরে তিনি ছটফট করতে লাগলেন।
এক সপ্তাহ পরে আবার যখন মোল্লা কফিলউদ্দিন বি. এ. বি. টি-র কাছ থেকে একটা চিঠি এসে হাজির হল তখন রইসউদ্দিনের হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। খুব ভয়ে ভয়ে চিঠিটা খুলে পড়লেন, কিন্তু এবারে চিঠির ভাষা সম্পূর্ণ অন্যরকম। সেখানে লেখা :
ভাই রাইচউদ্দিন,
আমার সালাম নিবেন। পর সমাচার এই যে, আপনাকে এর আগে অনেকগুলি পত্র লিখিয়া বিরক্ত করিয়াছি সেইজন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত। শিউলি একটু দুষ্টু প্রকৃতির মেয়ে তবে একটি বিশেষ কারণে তাহাকে আমার নিকট রাখিব বলিয়া মনস্থির করিয়াছি।
আপনি হয়তো এর কারণ জানিবার জন্য কৌতূহলী হইয়াছেন। অন্য দশজনকে বলিতে দ্বিধা করিতাম, কিন্তু আপনি নিজের মানুষ, আপনাকে বলিতে দ্বিধা নাই। আমাদের গ্রামের একজন মানুষ (তিনি বিশিষ্ট শিক্ষিত ব্যক্তি, নাম ফোরকান আলী) সম্প্রতি আমাকে একটি বিষয় সম্পর্কে অবহিত করিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেন কোনো কোনো মানুষের শরীরে নাকি কিডনি নামক একধরনের বস্তু থাকে, কাহারো একটি কাহারো দুইটি। ইহা শরীরের বিশেষ কোনো কাজে লাগে না কিন্তু বাহিরে অনেক উচ্চমূল্যে বিক্রয় করা সম্ভব। জনাব ফোরকান আলী শিউলিকে নিয়া শহরে গিয়াছিলেন। শহরের ডাক্তার পরীক্ষা করিয়া বলিয়াছেন তাহার দুইটি কিডনি রহিয়াছে (আলহামুদুলিল্লাহ্) এবং একজন খদ্দের তাহার কিডনি দুইটি ক্রয় করতে রাজি আছেন। বাজারে আজকাল এই কিডনি দুই হাজার টাকায় বিক্রয় হয় কিন্তু তিনি আমাকে আড়াই হাজার টাকা মূল্য দিতে রাজি হইয়াছেন।
মানুষটি আমাকে জানাইয়াছেন যে, এই কিডনি দুইটি দুইমাসের মাঝে আবার টিকটিকির লেজের মতো গজাইয়া যাইবে এবং ছয় মাসের মাঝে আবার কাটিয়া বিক্রয় করা সম্ভব হইবে। শিউলিকে এতদিন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করিয়াছি কিন্তু এখন আবিষ্কার করিলাম যে গাভিন গরু বা ফলবতী বৃক্ষ হইতে কোনো অংশে কম অর্থকরী নহে (সোবহান আল্লাহ্)। প্রথমবার বলিয়া কিডনির মূল্য লইয়া দরদাম করিতে পারি নাই। পরের বার বাজার যাচাই করিয়া ঠিক মূল্য না পাওয়া পর্যন্ত শিউলির কিডনি বিক্রয় করিব না ইনশাআল্লাহ।
আরজ গুজার
মোল্লা কফিলউদ্দিন বি. এ. বি. টি.
পুনশ্চ : আগামী মাসের ছয় তারিখ কিউনি বিক্রয় করিবার উদ্দেশ্যে শিউলিকে
.
লইয়া শহরে যাত্রা করিব। দোয়া রাখিবেন। চিঠি পড়ে রইসউদ্দিন হার্টফেল করার মতো অবস্থা হল। সব মানুষেরই দুটি কিডনি থাকে এবং অন্তত একটা কিডনি ছাড়া কোনো মানুষই বাঁচতে পারে না। অসুখবিসুখ বা রোগে-শোকে যখন মানুষের দুটি কিডনিই নষ্ট হয়ে যায় তখন শরীরের টিস্যু ইত্যাদি মিলিয়ে অন্য কোনো মানুষের শরীরের একটা কিডনি অপারেশন করে নিজের শরীরে লাগানো যায়, কিন্তু কেটে-ফেলা কিডনি কখনোই টিকটিকির লেজের মতো গজায় না। যারা নিজের কিডনি অন্যকে দিয়ে দেয় তাদের বাকি জীবন একটা কিডনি নিয়েই বেঁচে থাকতে হয়। সাধারণত খুব আপনজনেরা–যেরকম ভাইবোন বা ছেলেমেয়ে কিডনি দান করে। যদি কিডনি দেওয়ার মতো আপনজন না থাকে তা হলে কখনো কখনো অন্য কারও থেকে কিডনি নেওয়া হয়। অনেক সময় গরিব মানুষেরা টাকার জন্যে নিজের কিডনি বিক্রয় করারও চেষ্টা করে। কিন্তু ব্যাপারটি মোল্লা কফিলউদ্দিন যেভাবে বলেছেন মোটেও সেরকম নয়। কিডনি মোটেও টিকটিকির লেজ বা গাছের পেঁপে নয় যে, একবার কেটে নিলেও আবার গজিয়ে যাবে! মোল্লা কফিলউদ্দিন হয় নিজেই বড় প্রতারক, নাহয় আরও বড় প্রতারকের খপ্পরে পড়েছেন। তবে সেটা যা-ই হয়ে থাকুক না কেন তার ফল হিসেবে শিউলি নামের এই দুষ্টু মেয়েটার সব দুষ্টুমি সামনের মাসের ছয় তারিখের মাঝে শেষ হয়ে যাচ্ছে সে-ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।