চকলেট দুটি দেখেই বল্টু এবং খোকনের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল, শিরিন বানু সেটা দেখেও না-দেখার ভান করলেন, বললেন, “এসো বল্টু, এসো খোকন, চকলেট খেয়ে যাও।”
তারা নিজে থেকে এল না বলে শিরিন বানু মুখে হাসি ফুটিয়ে রেখে তাদের ধরে আনলেন, চকলেটের মোড়ক খুলে তাদের মুখে চকলেট গুঁজে দিলেন। কাজটি খুব সহজে করা গেল না, মৃদু ধস্তাধস্তি করতে হল। চকলেট মুখে নিয়ে তারা মুখ বিকৃত করে কয়েক সেকেন্ড বসে থেকে বাথরুমে ছুটে গেল।
বাথরুম থেকে মুখ ধুয়ে যখন ফিরে এসেছে তখন বল্টু আর খোকন দুজনেই মোটামুটি দুর্বল হয়ে এসেছে। স্কুলের যে-আপাটিকে খুব সহজেই একটা বড় শিক্ষা দিয়ে দেবে বলে ভেবেছিল, সেই কাজটি এখন আর খুব সহজ মনে হচ্ছে না। কাজটি যে প্রায় অসম্ভব হতে পারে সে-ব্যাপারে তারা নিশ্চিত হয়ে গেল যখন দেখল আপা হাতে তার চিরুনিটা নিয়ে অপেক্ষা করছেন। তাদের দেখে মিষ্টি করে হেসে বললেন, “আমি যখন তোমাদের মতো ছোট ছিলাম তখন চকলেট খেতে কী যে ভালো লাগত! তোমরা দেখি একেবারেই চকলেট খেতে চাও না!
বল্টু আর খোকন কী বলবে বুঝতে পারল না, খানিকটা হতভম্বের মতো শিরিন বানুর দিকে তাকিয়ে রইল। শিরিন বানু বললেন, “তোমাদের সাথে তো
রীতিমতো কুস্তি করতে হল, দেখো তোমাদের চুলের কী অবস্থা! কাছে এসো, চুল ঠিক করে দিই।”
বল্টু আর খোকন কাঁদোকাঁদো হয়ে গেল, ভাঙা গলায় বলল, “লাগবে না আপা, লাগবে না।”
“কেন লাগবে না! কী মিষ্টি তোমাদের চেহারা–চুল আঁচড়ে নিলে আরও কত সুন্দর দেখাবে। এসো, কাছে এসো।”
কাঁচপোকা যেভাবে তেলাপোকাকে টেনে আনে আপা সেভাবে দুজনকে টেনে এনে চুল আঁচড়ে দিলেন। তাদের মাথায় কোথায় চিউয়িংগামটা লেগেছে সেটা এখন আর পরীক্ষা করার উপায় নেই।
চুল আঁচড়ে মোটামুটি ভদ্র সেজে দুজন আবার পড়তে বসল, যে-জিনিসটা শেখাতে স্কুলের অন্য ছেলেমেয়েদের কয়েক সপ্তাহ লেগে যায় এই দুজন সেটা এক ঘণ্টার মাঝে শিখে ফেলল। এই আশ্চর্যরকম বুদ্ধিমান দুজন বাচ্চার জন্যে শিরিন বানু নিজের ভেতরে এক গভীর মায়া অনুভব করলেন, কিন্তু সেটা আর তাদের সামনে প্রকাশ করলেন না।
বিদায় নেবার সময় উঠে দাঁড়াতেই বল্টু আর খোকনের চোখে হঠাৎ করেএক মুহূর্তের জন্যে একটা উত্তেজনার চিহ্ন দেখে শিরিন বানু বুঝতে পারলেন তাকে নাস্তানাবুদ করার ব্যাপারটি এখনও শেষ হয়নি। কী হতে পারে সেটা একটু অনুসন্ধান করতেই দরজার ওপর রাখা ঠোঙাটা তার চোখে পড়ল। সেটা না দেখার ভান করে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন এবং দরজার কাছে গিয়ে হঠাৎ কিছু-একটা মনে পড়েছে এরকম ভঙ্গি করে দুজনকে ডাকলেন, বল্টু আর খোকন খুব সহজেই তার ফাঁদে পা দিল। বল্টু আর খোকনকে স্কুলসংক্রান্ত কিছু-একটা উপদেশ দিয়ে দুজনকে দুই হাত ধরে রেখে নিজের সামনে রেখে শিরিন বানু দরজায় হাত দিলেন।
সাথে সাথে দরজার উপরে খুব সাবধানে বসিয়ে-রাখা ঠোঙাটা উলটে নিচে পড়ল, এর ভেতরে ময়দা বা আটা যেটাই রাখা ছিল সেটা উপুড় হয়ে পড়ল দুজনের মাথায়। এমনিতে দুর্ঘটনাটা ঘটলে এত নিখুঁতভাবে তাদের মাথায় পড়ত কি না সন্দেহ ছিল, কিন্তু শিরিন বানু চোখের কোনা দিয়ে ঠোঙাটাকে লক্ষ করে দুজনকে ঠেলে ঠিক সময় ঠিক জায়গায় দাঁড় করিয়ে রাখলেন। মাথার উপর সরাসরি এক ঠোঙা ময়দা পড়ার পর দুজনের যা একটা চেহারা হল সে আর বলার মতো নয়! শিউলি তাদের দেখে পেটে হাত দিয়ে যেভাবে হি হি করে হাসতে শুরু করল যে তার শব্দে বসার ঘর থেকে রইসউদ্দিন এবং রান্নাঘর থেকে মতলুব মিয়া এসে হাজির হল।
যে-ময়দা দিয়ে সকালে পরোটা তৈরি হয় নাশতা করার জন্যে, বল্টু আর খোকন কেন সেটা মাথায় দিয়ে বসে আছে সেটা ব্যাখ্যা করা খুব সহজ হল না। শিরিন বানু খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাদের ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করতে দেখলেন কিন্তু সেটা তাঁর জন্যে হজম করা খুব কঠিন হয়ে পড়ল। হাসি চেপে কোনোরকমে চলে যাবার আগে শুধু তাদের মনে করিয়ে দিলেন বল্টু আর খোকন যদি পরদিন স্কুলে না যায় শিরিন বানু পরদিন আবার চলে আসবেন।
বল্টু আর খোকনের মাথায় সেখানে চিউয়িংগাম লেগে গেছে সেটা দূর করা খুব সহজ হল না। এরকম সময় যা করতে হয় এবারেরও তাই করা হল খানিকটা চুল কাঁচি দিয়ে কেটে ফেলতে হল। সামনে থেকে সেটা দেখা যাচ্ছিল
বলে বল্টু আর খোকন বেশি বিচলিত হল না, কিন্তু পিছন থেকে দেখে হাসতে হাসতে শিউলির চোখে পানি এসে গেল। সে চোখ মুছে বলল, “এই বল্টু আর খোকন, এই আপা তোদের একেবারে ছাগল বানিয়ে ছেড়ে দিয়েছে।”
বল্টু চোখ পাকিয়ে শিউলির দিকে তাকাল। শিউলি হাসি থামিয়ে বলল, “খামোখা আপার সাথে লাগাতে যাবি না। কাল থেকে সময়মতো স্কুলে যাবি।”
বল্টু আর খোকন কিছু বলল না, কিন্তু তারা টের পেয়ে গেছে স্কুলে তাদের যেতেই হবে। যে-স্কুলে হাজির না হলে স্কুলটাই বাসায় হাজির হয়ে যায় তার থেকে রক্ষা পাবার উপায় কী?”
০৮. বিকালবেলা শিউলি, বল্টু আর খোকন
০৮.
বিকালবেলা শিউলি, বল্টু আর খোকন হাঁটতে বের হয়েছে। বল্টু আর খোকন আজকাল পড়তে শিখে গেছে, দোকানের সাইনবোর্ড দেখলেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেটা পড়ার চেষ্টা করে। বড় একটা গয়নার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে বল্টু সাইনবোর্ডটা পড়ে শেষ করল, “হীরামন জুয়েলার্স ডড নং কামারপাড়া রোড।” বল্টু একটু অবাক হয়ে শিউলির দিকে তাকিয়ে বলল, “শিউলি আপু, ডড নং মানে কী?”