“তোমরা খুশি হয়েছ শুনে আমিও খুশি হয়েছি।”
“আপনি খুশি হয়েছেন শুনে আমরাও খুশি হয়েছি। আমরা তাই আপনার জন্যে দুইটা চকলেট নিয়ে এসেছি।”
“চকলেট! বাহ্! কী চমৎকার! চকলেট আমার সবচেয়ে ফেবারিট।”
বল্টু তখন কাঁপাহাতে আপার হাতে দুইটা চকলেট তুলে দিল। সারাদিন খেটেখুটে চকলেটটা তৈরি হয়েছে। মাটির ঢেলা সাথে মরিচের গুঁড়া। উপরে খয়েরি রং দেখে চকলেটই মনে হয়। আপা ব্যাগ খুলে ভেতরে চকলেট দুটি রাখলেন। বললেন, “বাসায় গিয়ে খাব।”
আবার পড়াশোনা শুরু হল। বল্টু তখন সাবধানে আপার ব্যাগ খুলে তার চিরুনিটা বের করে সেখানে একটা চুইংগাম লাগিয়ে দিল। তার হাতের কাজের কোনো তুলনা নেই, আপা কিছু টের পেলেন না। চুইংগামটা আগেই চিবিয়ে নরম করে টেবিলের তলায় লাগিয়ে রাখা ছিল–একেবারে পাকা কাজ, কোনো ভুলত্রুটি নেই। আরও খানিকক্ষণ কেটে গেল, খোকন হঠাৎ মাথা তুলে বলল, “আপা!”
“কী হল?”
“চা খাবেন?”
“না খোকন, চা খাব না। থ্যাংকিউ।”
“চা খাবেন না?” খোকনকে হঠাৎ বিচলিত দেখা গেল, “চা না খেলে কেমন করে হবে? চা খেতেই হবে আপা।”
“খেতেই হবে?”
“হ্যাঁ।”
“ঠিক আছে তা হলে খাব।”
“আমি চা নিয়ে আসি আপা।”
খোকন ঘর থেকে বের হয়ে গেল এবং প্রায় সাথে সাথে এক কাপ চা নিয়ে এল। শিরিন বানু দীর্ঘদিন থেকে দুষ্টু ছেলেমেদের নিয়ে কাজ করে আসছেন, তাদের দুষ্টুমি ধরে ফেলার তার একটা আলাদা ক্ষমতা রয়েছে। এবারেও হঠাৎ করে খোকনের চায়ের কাপ নিয়ে আসার ভঙ্গিটা দেখে তাঁর মাথায় একটা সন্দেহ উঁকি দিল। চায়ের রং এবং সেখান থেকে বের হওয়া মরিচের সূক্ষ্ম একটা ঘ্রাণ দেখে তাঁর সন্দেহটা পাকা হয়ে গেল, কিন্তু শিরিন বানু তাঁর ভাবভঙ্গিতে সেটা প্রকাশ করলেন না। কাপটা নিজের কাছে টেনে নেবার ভঙ্গি করে এক ফোঁটা চা আঙুলে লাগিয়ে নিলেন এবং পড়ানোর ফাঁকে একসময় অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে জিবে লাগিয়ে সেটা চেখে দেখলেন, ভয়ংকর তেতো এবং ঝাল, উকট একটা গন্ধও রয়েছে সেখানে। দুষ্টু ছেলেমেয়েগুলো কী করতে চাইছে বুঝতে তার একটুও দেরি হল না। চায়ের কাপটা মুখের কাছে নিয়ে খাবার ভঙ্গি করে হঠাৎ থেমে গিয়ে বললেন, “শুধু আমি একা খাব সেটা কেমন করে হয়?”
“আমরা খেয়েছি আপা। আপনি খান।”
শিরিন বানু কোনো কথা না বলে পিরিচে খানিকটা চা ঢাললেন, সেটাকে ঠাণ্ডা হওয়ার মতো সময় দিলেন, তারপর খোকনের গাল ধরে আদর করার ভঙ্গি করে বললেন, “আমার সাথে একটুও খাও খোকন।”
খোকনের মুখ আতঙ্কে ফ্যাকাশে হয়ে গেল। সে মাথা নাড়তে থাকে এবং হঠাৎ করে টের পায় তার গালটি আদর করে ধরে রাখলেও তার একটুকু নড়ার উপায় নেই। বাচ্চাদের তিতকুটে ওষুধ খাওয়ার সময় মায়েরা যেভাবে ছোট বাচ্চার মুখ ধরে রেখে সেখানে ওষুধ ঢেলে দেয় অনেকটা সেভাবে শিরিন বানু খোকনের মুখে খানিকটা চা ঢেলে দিলেন। খোকনের চোখ গোল গোল হয়ে গেল, ভয়ংকর বিস্বাদ চা এক ঢোক খেয়েও ফেলল, তারপর লাফিয়ে উঠে তিড়িং বিড়িং করে লাফাতে লাগল। শিরিন বানু মুখে হাসি ফুটিয়ে রেখে বল্টুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “চা খেয়ে অভ্যাস নেই খোকনের, একফোঁটা চা খেয়ে কী করছে দেখেছ?”
বল্টু দুর্বলভাবে মাথা নাড়ল, কিছু-একটা বলতে চাইছিল কিন্তু তার আগেই। আপা তার গালটা ধরে ফেলেছেন। হাসিহাসি মুখে করে বললেন, “তুমি তো চা খাও, তাই না?”
বল্টু মাথা নাড়ানোর চেষ্টা করল কিন্তু পারল না। আপাকে দেখে বোঝা যায়
কিন্তু তার আঙুলগুলোতে অসম্ভব জোর। মনে হয় জানালার শিক এক আঙুলে বাঁকা করে ফেলবেন। বল্টু কিছু বোঝার আগে আপা তার মুখ ফাঁক করে সেখানে খানিকটা চা ঢেলে দিয়েছেন। মনে হল কেউ বুঝি তার মুখের ভেতরে পেট্রল ঢেলে সেখানে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে বল্টু সারা ঘরময় ছোটাছুটি করতে থাকে, কী করবে বুঝতে না পেরে শেষ পর্যন্ত জানালার কাছে গিয়ে কুলি করে চাটুকু বের করে দিল।
শিরিন বানু মুখে বিস্ময় ফুটিয়ে বললেন, “কী হল তোমাদের? একটু চা খেয়ে এরকম লাফালাফি করছ কেন?”
বল্টু মুখ হাঁ করে নিঃশ্বাস নিতে নিতে বলল, “চা–চা’টা ঠিক করে তৈরি হয় নাই।”
“ঠিক করে তৈরি হয় নাই?”
“না। ভু-ভু ভুল করে ঝাল দিয়ে দিয়েছে।”
“তাই নাকি? শিরিন বানু খুব অবাক হবার ভান করলেন, “ঝাল চা তো কখনো শুনিনি! দেখি কেমন।”
শিরিন বানু কাপ থেকে সুড়ৎ করে এক চুমুক চা চুমুক দেবার ভান করে বললেন, “বেশি ঝাল তো নয়, খাওয়া যাচ্ছে। তোমরা খাবে আরেকটু?”
খোকন আর বল্টু জোরে জোরে মাথা নাড়ল, “না আপা, না।”
“কেন না?”
“খু-খু-খুব ঝাল লেগেছে।”
শিরিন বানুর চোখ হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, “মিষ্টি কিছু খেলে মুখের ঝাল কেটে যাবে। আমার কাছে আছে। এসো।”
শিরিন বানু তার ব্যাগ থেকে দুটি চকলেট বের করলেন, একটু আগে বল্টু এবং খোকন তাকে চকলেট দুটি দিয়েছে। মোড়ক না খুলেই এখন তিনি বলতে পারেন এগুলো নিরীহ চকলেট নয়। শুধু তাই না, ব্যাগ খুলে তিনি আর একটা জিনিস আবিষ্কার করলেন, তাঁর চিরুনিটার মাঝে কীভাবে জানি খানিকটা চিউয়িংগাম আটকে রয়েছে, মাথার চুলে চিউয়িংগাম লাগিয়ে দেওয়ার ব্যাপারটি তিনি বহুঁকাল থেকে জানেন। তাঁর সামনে বসে থেকে এই দুইটি বাচ্চা কীভাবে তার ব্যাগ খুলে সেখানে তাঁর চিরুনিতে চিউয়িংগাম লাগিয়ে দিয়েছে তিনি চিন্তা করে পেলেন না, কিন্তু যেভাবেই সেটা করে থাকুক সেটার জন্যে তাদের বাহবা দেওয়া উচিত। শিরিন বানু অবিশ্যি তখন-তখনই কোনো বাহবা দিলেন না, তাঁর মুখে মুগ্ধ হওয়ার কোনো চিহ্নও ফুটে উঠল না।