রইসউদ্দিন ঠিক বুঝতে পারলেন না শিরিন বানু জিনিসটা প্রশংসা করে বলেছেন কি না, তাই অনিশ্চিতের মতো মাথা নেড়ে মুখে খানিকটা হাসি মাখিয়ে বসে রইলেন। শিরিন বানু বললেন, “আমার স্কুলে বল্টু আর খোকন হচ্ছে সবচেয়ে বুদ্ধিমান ছাত্র। কিন্তু তারা গত তিনদিন থেকে স্কুলে আসছে না।”
“সে কী!” রইসউদ্দিন অবাক হয়ে বললেন, “মতলুব মিয়া যে বলল তারা স্কুলে যাচ্ছে!”
“না। যাচ্ছে না।”
“আপনি দাঁড়ান, আমি ডেকে জিজ্ঞেস করি।”
বল্টু আর খোকনকে ডাকা হল এবং ঘরে ঢুকে শিরিন বানুকে দেখে দুজনেই ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। চেয়ারে রইসউদ্দিন এবং দরজায় মতলুব মিয়া না থাকলে দুজনেই উঠে একটা দৌড় লাগাত তাতে কোনো সন্দেহ নেই। শিরিন বানু মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন, “কী ব্যাপার মিস্টার বল্টু এবং মিস্টার খোকন? আমাকে চিনতে পেরেছ?”
দুজনে ফ্যাকাশে মুখে মাথা নাড়ল শিরিন বানু বললেন, “আমি খোঁজ নিতে এলাম। স্কুলে আসছ না কেন?”
দুজনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। শিরিন বানু বললেন, “কী হল, কথা বলছ না কেন?”
বল্টু কিছু-একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল। শিরিন বানু বললেন, “বলে ফেলো, কী বলতে চাও।”
বল্টু শেষ পর্যন্ত খানিকটা সাহস সঞ্চয় করে বলল, “পড়ে কী হবে?”
শিরিন বানু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “আমাকে জিজ্ঞেস করো ‘পড়ে কী হবে না, দেখি বলতে পারি কি না।”
“পড়ে কী হবে না?”
“পড়ে সাঁতার শেখা যায় না, পানিতে নামতে হয়। পড়ে সাইকেলও চালানো যায় না, সাইকেলে উঠে প্র্যাকটিস করতে হয়। এ ছাড়া মোটামুটি সবকিছু বই পড়ে করা যায়।”
চোখের মাঝে দুষ্টুমি ফুটিয়ে খোকন জিজ্ঞেস করল, “বই পড়ে ওড়া যায়?”
“যায়। হ্যাঁন্ড-গ্লাইডার দিয়ে মানুষজন পাখির মতো আকাশে ওড়ে। বই না পড়লে তুমি হ্যাঁন্ড-গ্লাইডার ডিজাইন করতে পারবে না। যা-ই হোক এখন আসল কারণ বলো, স্কুলে কেন আসছ না?”
বল্টু বলল, “পড়তে ভালো লাগে না।”
খোকন বলল, “কিছু বুঝি না।”
শিরিন বানু মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন, “তা হলে তো কোনো সমস্যাই নেই। কাল থেকে স্কুলে যাবে।”
“কেন আপা?”
“তোমাদের যেন পড়তে ভালো লাগে আর পড়ে যেন সবকিছু বোঝ আমি তার ব্যবস্থা করব।”
“কীভাবে?”
“গেলেই দেখবে।”
“আর যদি না যাই?”
“যদি না যাও তা হলে আমি বই-খাতা নিয়ে বাসায় চলে আসব।”
বল্টু আর খোকন অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে শিরিন বানুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, আপা নিশ্চয়ই ঠাট্টা করছেন। এটা তো সত্যিই হতে পারে না যে স্কুলের একজন আপা পড়ানোর জন্যে বাসায় চলে আসবেন।
পরের দিনটা বল্টু আর খোকন খুব অশান্তি নিয়ে কাটাল। স্কুলে তারা আর যাবে না ঠিক করে ফেলেছে। আর কয়দিন পরেই শিউলির ছোট চাচা এসে শিউলিকে নিয়ে আমেরিকা চলে যাবেন, তখন বল্টু আর খোকন যে যার মতো চলে যাবে। এই অল্প কয়দিন তারা একসাথে আছে, তিনজনই এমন ভান করছে যে তারা যেন আপন ভাইবোন! আসলে তো সেটা সত্যি না, কাজেই ভালো জামাকাপড় পরে বড়লোকদের বাচ্চার মতো স্কুলে গিয়ে আর কী হবে?
সন্ধ্যেবেলা সত্যি সত্যি তো আর স্কুলের আপা চলে আসবে না, কিন্তু সত্যিই যদি চলে আসেন তার জন্যে বল্টু আর খোকন ব্যবস্থা করে রাখল। আপাকে এমন একটা শিক্ষা দিয়ে দেবে যে আপা আর জন্মেও এইমুখো আসবেন না! কী করা যায় সেটা নিয়ে অনেক চিন্তা-ভাবনা করেছে, তাদের মাথা থেকে বেশি বুদ্ধি বের হয়নি, কিন্তু শিউলি অনেকগুলো বুদ্ধি দিয়েছে। এইসব ব্যাপারে শিউলির বুদ্ধি একেবারে এক নম্বুরি! চিনি না দিয়ে লবণ আর মরিচের গুঁড়ো দিয়ে চা, আপার চিরুনিতে চুইংগাম চিবিয়ে লাগিয়ে দেওয়া, মাটির ঢেলা দিয়ে চকলেট তৈরি করা, দরজার উপরে ঠোঙার মাঝে ময়দা ভরে রাখা যেন দরজা খুলতেই মাথার উপরে এসে পড়ে–এইরকম অনেকগুলো বুদ্ধির ধারা করে রাখা হল।
সন্ধ্যের একটু পরে সত্যি সত্যি শিরিন বানু এসে হাজির হলেন। বল্টু আর খোকনকে পড়াতে এসেছেন শুনে মতলুব মিয়া তাঁকে তাদের ঘরে নিয়ে গেল, চেয়ারে বসিয়ে বলল, “খামোখা চেষ্টা করছেন আপা, বদের হাড়ি এরা, জীবনেও পড়বে না।”
“চেষ্টা করে দেখি।”
“কোথায় আর চেষ্টা করছেন? বেত কই আপনার? বেত ছাড়া চেষ্টা হয় নাকি?”
শিরিন বানু কিছু বললেন না, কিছুক্ষণের মাঝে বল্টু আর খোকন অপরাধীর মতো মুখ করে এসে হাজির হল। মজা দেখার জন্যে পিছুপিছু এল শিউলি। এই বাসায় যে-জিনিসটা কেউ এখন পর্যন্ত ভালো করে লক্ষ করেনি শিউলির সেটা প্রথমেই চোখে পড়ল। এই মহিলাটি যদি তাঁর চুলকে শক্ত করে পেছনে টেনে না বেঁধে একটু ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে ছড়িয়ে দিতেন, চোখের চশমাটা খুলে ফেলতেন, এরকম সাদাসিধে একটা শাড়ি না পরে সবুজ, জমিনের উপর হালকা কাজ করা একটা শাড়ি পরতেন, ঠোঁটে একটু লিপস্টিক লাগিয়ে মুখের কঠিন ভাবটা সরিয়ে মুখে একটা মিষ্টি হাসি দিতেন তা হলে তাঁকে রীতিমত সুন্দরী বলে চালিয়ে দেওয়া যেত।
শিরিন বানু অবশ্য নিজের চেহারা নিয়ে একেবারেই মাথা ঘামান বলে মনে হল না। ব্যাগ থেকে বই-খাতা বের করে বল্টু আর খোকনকে পড়াতে শুরু করে দিলেন। স্বরবর্ণ শেষ করে ব্যঞ্জনবর্ণে যেতে-না-যেতেই বল্টু তাকে থামিয়ে বলল, “আপা!”
“কী হল?”
”আপনি যে পড়াতে এসেছেন সেজন্যে খুব খুশি হয়েছি।”