“ঠিক আছে চাচা, আর কেউ আসবে না।”
“মনে থাকে যেন!”
“মনে থাকবে।”
সপ্তাহ দুয়েক পর শিউলির ছবি পেয়ে তার ছোট চাচা আবার বিশাল একটা চিঠি লিখলেন রইসউদ্দিনকে। চিঠির শেষে লিখলেন, “… আপনার পাঠানো ছবিতে শিউলির সাথে আপনার ফুটফুটে দুই ছেলেকে দেখে বড় ভালো লাগল। ছবিতে শিউলির মুখে যে-হাসি দেখেছি সেটি দেখে আমি নিঃসন্দেহ হয়েছি মেয়েটিকে আপনি আপনার নিজের মেয়ের মতো করেই দেখেশুনে রাখছেন। শিউলির বড় সৌভাগ্য সে আপনার মতো একজনের ভালোবাসা পেয়েছে। আপনার জন্যে, আপনার স্ত্রীর জন্যে এবং আপনার ফুটফুটে দুই ছেলের জন্যে অসংখ্য ভালোবাসা।…”
পুরো ব্যাপারটি কেমন করে শিউলির ছোট চাচাকে বোঝাবেন রইসউদ্দিন চিন্তা করে পেলেন না। শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা নিয়ে চুপচাপ থাকাই তার কাছে বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে হল। সামনাসামনি যখন দেখা হবে তখন ব্যাপারটি বুঝিয়ে দিলেই হবে।
০৭. সকালবেলা শিউলি যখন স্কুলে যায়
০৭.
সকালবেলা শিউলি যখন স্কুলে যায় তখন বল্টু আর খোকন তার সাথে বের হয়ে যায়, তাকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে দুজন শহর ঘুরতে বের হয়। শিউলি আগে স্কুলে গিয়েছে বলে তাকে এখানে স্কুলে দিতে সমস্যা হয়নি। কিন্তু বল্টু আর খোকন পড়ালেখা জানে না, তাদেরকে স্কুলে ঢোকানো ভারি সমস্যা। এখন স্কুলে পড়তে হলে তাদের একেবারে ক্লাস ওয়ানের বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েদের সাথে পড়তে হবে, কিন্তু কোনো স্কুলই সেভাবে নিতে রাজি নয়। স্কুলে পড়তে হবে না জেনে বল্টু আর খোকনের দুজনেরই মনে ভারি আনন্দ।
কিছুদিনের মাঝেই অবিশ্যি এই আনন্দে ভাটা পড়ল–মতলুব মিয়া একদিন খবর আনল কাছেই এন, জি. ও-র লোকজন মিলে একটা স্কুল দিয়েছে, যত ভিখিরির ছেলেমেয়েরা সেখানে নাকি পড়তে যাচ্ছে। মতলুব মিয়া শুনেছে অত্যন্ত কড়া একজন মাস্টারনি এসেছেন। পান থেকে চুন খসলে নাকি রক্তারক্তি কারবার হয়ে যায়–বল্টু আর খোকনকে শায়েস্তা করার এর থেকে ভালো উপায় আর কী হতে পারে।
।রইসউদ্দিন খবর পেয়ে বল্টু আর খোনকে সত্যি সত্যি একদিন এই স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়ে এলেন। বাসায় কাজের ছেলেমেয়েরা, টোকাই, মিস্ত্রিরা এই স্কুলে পড়তে আসে বলে এটা শুরু হয় দুপুরবেলা, দুঘণ্টা পরে ছুটি। প্রথম কয়েকদিন বল্টু আর খোকন বেশ উৎসাহ নিয়েই গেল, কিন্তু যখন সত্যি সত্যি অক্ষয়-পরিচয় করিয়ে পড়াশোনা শুরু হয়ে গেল তখন তাদের উৎসাহ পুরোপুরি উবে গেল। ঘর থেকে স্কুলে যাবার নাম করে তারা বের হত, কিন্তু কোনোদিন যেত বাজারে, কোনোদিন রেল-স্টেশনে। তারা মনে করেছিল ব্যাপারটা কোনোদিন ধরা পড়বে না, কিন্তু দেখা গেল ব্যাপারটা এত সহজ নয়। সন্ধ্যেবেলা শিউলি পড়তে বসেছে এবং বল্টু আর খোকন মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে যোললাগুটি খেলছে ঠিক তখন দরজায় একটা শব্দ হল। মতলুব মিয়া দরজা খুলে দেখে ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছরের একজন ভদ্রমহিলা। সাধারণ একটা শাড়ি পরে এসেছেন, চোখে চশমা, কাঁধ থেকে বড় একটা ব্যাগ ঝুলছে। মতলুব মিয়াকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, “এইখানে কি বল্টু আর খোকন থাকে?”
মতলুব মিয়া কানে আঙুল দিয়ে কান চুলকাতে চুলকাতে বলল, “থাকার কথা না, কিন্তু এখন থাকে।”
বল্টু আর খোনকে পেয়ে মনে হল ভদ্রমহিলা খুব আশ্বস্ত হলেন। ঘরের ভেতরে ঢুকে বললেন, “আমি কি ওদের গার্জিয়ানের সাথে কথা বলতে পারি?”
মতলুব মিয়া ঘাড় বাঁকা করে বলল, “কী করেছে ঐ দুই বদমাইশ আমাকে বলেন। পিটিয়ে সিধে করে ছেড়ে দেব। আমাকে চিনে না। হু!”
ভদ্রমহিলা বললেন, “না, এটা পিটিয়ে সিধে করার ব্যাপার নয়–আর সত্যি কথা বলতে কী, যে-সমস্যা পিটিয়ে সমাধান করা হয় সেটা সমাধান না করাই ভালো।”
ভদ্রমহিলা কী বলছেন মতলুব মিয়া ঠিক বুঝল না, কিন্তু ভান করল সে পুরোটাই বুঝেছে।
“আমি কি একটু ওদের গার্জিয়ানের সাথে কথা বলতে পারি?”
“জি। আপনি বসেন, আমি ডেকে আনি।”
রইসউদ্দিন খালিগায়ে লুঙ্গি পরে বসে বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন। একজন ভদ্রমহিলা দেখা করতে এসেছে শুনে লুঙ্গি পালটে প্যান্ট আর একটা ফুলহাতা শার্ট পরে বাইরে এলেন। ভদ্রমহিলা তাঁকে দেখে দাঁড়িয়ে সালাম দিয়ে বললেন, “আমার নাম শিরিন বানু, এই এলাকায় বাচ্চাদের যে-স্কুলটা ভোলা হয়েছে আমি তার শিক্ষিকা। বল্টু আর খোকন আমার স্কুলের ছাত্র, তাদের নিয়ে একটু কথা বলতে এসেছিলাম।”
রইসউদ্দিন মহিলাদের সাথে ঠিক কথা বলতে পারেন না। খানিকক্ষণ হাঁ করে থেকে বললেন, “ও হ্যাঁ। মানে ঠিক আছে কিন্তু মানে ইয়ে, ও হ্যাঁ। বেশ তা হলে-”
শিরিন বানু বললেন, “আমি কি বসতে পারি?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, বসেন।”
শিরিন বানু বসলেন। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “বল্টু আর খোকন দুজনই অত্যন্ত বুদ্ধিমান ছেলে। আমার ধারণা তাদের আই কিউ একশো চল্লিশের বেশি হবে। এদের সাথে আপনার সম্পর্কটা ঠিক কীরকম একটু জানতে চাচ্ছিলাম।”
রইসউদ্দিন তখন কীভাবে শিউলি, বল্টু এবং খোকনের পাল্লায় পড়েছেন ব্যাপারটি বুঝিয়ে বললেন। শুনে শিরিন বানু অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বললেন, “আপনি তো সাংঘাতিক মানুষ! আপনি জানেন আজকাল আপনাদের মতো মানুষ খুব বেশি পাওয়া যায় না?”