নতুন ক্যামেরা নিয়ে শিউলির ছবি তুলতে গিয়ে দেখা গেল পথেঘাটে ছবি তোলা খুব সহজ নয়। ঠিক ছবি তোলার সময় কোনো-একজন ক্যামেরার সামনে হেঁটে চলে আসে। শিউলির তিনটি ছবি তুললেন রইসউদ্দিন, একটার মাঝে একজন ভিখিরি, একটার মাঝে একজন ফিরিওয়ালা, আরেকটার মাঝে একটা ছাগল ঢুকে গেল। বল্টু তখন বলল”এক কাজ করলে হয়।”
“কী কাজ?”
“শিশুমেলা চলে গেলে হয়।”
“শিশুমেলা?” রইসউদ্দিন জিজ্ঞেস করলেন, “সেটা কী জিনিস?”
বল্টু চোখ বড় বড় করে বলল, “ফাটাফাটি জায়গা। নাগরদোলা আছে। ভূতের ট্রেন আছে। ছবি ভোলার জন্যে একেবারে ফাস ক্লাস জায়গা।”
শিউলি রইসউদ্দিনের দিকে তাকিয়ে বলল, “চলেন সেখানে যাই।”
রইসউদ্দিন বললেন, “ঠিক আছে, চলো যাই। বের যখন হয়েছি সবকিছু দেখে আসি।”
সবাই আবার স্কুটারে চেপে চলে এল শিশুমেলায়। টিকেট কেটে ভেতরে ঢুকে চারদিকে শিশুদের হৈচৈ আনন্দ দেখে শিউলি, বল্টু আর খোকনের প্রায় মাথা-খারাপ হওয়ার মতো অবস্থা। তিনজনে যখন আনন্দে ছোটাছুটি করছে তখন রইসউদ্দিন তাদের কয়েকটা ছবি নিলেন। মেলায় বাচ্চাদের আনন্দ করার নানা কিছু রয়েছে, কেন এইসব বিদঘুঁটে কাজ করে বাচ্চারা আনন্দ পায় সেটা নিয়ে। রইসউদ্দিনের মনে প্রশ্ন ছিল, কিন্তু চোখের সামনে সেটা দেখে অবিশ্বাস করবেন কী করে? ছোট বাচ্চাদের সাথে বোকার মতো একজন বড় মানুষ একটার মাঝে উঠে পড়েছিল, একটা চেয়ারের মতো জায়গা–সেটাকে উপরে-নিচে এবং ডানে বাঁয়ে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে ঘোরাতে থাকে। তার ভেতরে বাচ্চাগুলো আনন্দে এবং বয়স্ক মানুষটি আতঙ্কে চিৎকার করতে থাকে–রইসউদ্দিন দেখলেন বারকয়েক ঝাঁকুনি খেয়ে বয়স্ক মানুষটি হঠাৎ হড়হড় করে বমি করে দিল কিন্তু ছোট বাচ্চাদের আনন্দের এতটুকু ঘাটতি হল না।
নাগরদোলা চেপে, রাইডে চড়ে, নৌকায় উঠে, ভিডিও গেম খেলে, ট্রেন চেপে ছোটাছুটি করে শেষ পর্যন্ত তিনজন ক্লান্ত হয়ে পড়ল। রইসউদ্দিন তাদের সাথে কিছুই করেননি কিন্তু তিনজনের পেছনে পেছনে ঘুরে আরও বেশি ক্লান্ত হয়ে গেলেন। মেলার মাঝে এক কোণায় খাবারের দোকান, সেটা দেখে একসাথে সবার খিদে পেয়ে গেল। বাইরে বেঞ্চে বসে সবাই হট প্যাটিস আর পেপসি খেল।
খেতে খেতে আড়চোখে তাকিয়ে শিউলি দেখল তাদের পাশেই একটা বাচ্চা বসেছে, বাচ্চাটি ভীষণ মোটা। একগাদা খাবার নিয়ে কপাকপ করে খাচ্ছে, তখন পাশে বসে-থাকা মা বললেন, “আর খাসনে বাবা।”
ছেলেটা খাবার-মুখে চিবুতে চিবুতে বলল, “কেন খাব না?”
“পেটের মাঝে ভুটভাট করবে।”
“যাও! বলে বাচ্চাটা তার মায়ের কথা উড়িয়ে দিয়ে আবার গবগব করে খেতে লাগল।
খোকন হঠাৎ মাথা এগিয়ে দিয়ে ফিসফিস করে বলল, “দেখ মজা।”
সাথে সাথে হঠাৎ সবাই স্পষ্ট শুনল ছেলেটার পেট বিকট শব্দে ডেকে উঠল। মা বললেন, “ঐ দেখ তোর পেট কেমন শব্দ করছে।”
ছেলেটা পেটে একটা চাটি মারতেই শব্দ বন্ধ হয়ে গেল। খানিকক্ষণ যেতে আবার পেটের ভেতর বিকট শব্দ, এবারে আগের থেকেও জোরে। তার মা বললেন, “আর খাসনে বাবা!”
ছেলেটা আবার পেটে একটা চাটি মারল, সাথে সাথে শব্দ বন্ধ হয়ে গেল, কিন্তু প্রায় সাথে সাথেই আবার আরও বিকট শব্দে পেট ডেকে উঠল। ছেলেটা এবারে কেমন যেন সতর্ক হয়ে উঠে দাঁড়াল, বলল, “আর খাব না মা। চলো বাড়ি যাই। পেটের ভেতর কেমন জানি করছে।”
ছেলেটা আর তা মা-উঠে যাবার সাথে সাথেই শিউলি, বল্টু আর খোকন হিহি করে হাসতে শুরু করল, তাদের হাসি আর থামতেই চায় না। কাছেই রইসউদ্দিন। বসেছিলেন, তিনি বুঝতেই পারলেন না কী এমন হাসির ব্যাপার হয়েছে।
রাতে বাসায় ফিরে আসার সময় স্কুটারে বসে বসে তিনজনের চোখেই ঘুম নেমে আসে, আধোঘুমে কেউ-না আবার স্কুটার থেকে পড়ে যায় সেই ভয়ে রইসউদ্দিন তিনজনকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে রাখলেন। স্কুটারের ঝাঁকুনিতে বাচ্চাগুলোর মাথা তার বুকের মাঝে ঘষা খেয়ে যাচ্ছিল আর হঠাৎ করে রইসউদ্দিনের বুকের মাঝে কেমন জানি করতে থাকে। তার মনে হতে থাকে একা একা নিঃসঙ্গভাবে বেঁচে না থেকে তিনিও যদি বিয়ে করে সংসারী হতেন তা হলে এমন হয়তো তার নিজের এরকম কয়জন সন্তান হত, তাদের হাত ধরে তিনি শিশুমেলা নিয়ে যেতেন। কিন্তু এখন তার জন্যে খুব দেরি হয়ে গেছে।
রাত্রিবেলা খাবার পর শিউলি এসে খুব কাঁচামাচু হয়ে বলল, “চাচা!”
“কী হল?”
“আমার ছোট চাচা তো অনেক টাকা পাঠিয়েছে, তা-ই না?”
“হ্যাঁ, পাঠিয়েছেন।”
“এই টাকা খরচ করে–ইয়ে-মানে ইয়ে–”
“কী?”
“খোকনকে আমাদের সাথে রাখতে পারি না?”
রইসউদ্দিন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “খোকনের নিজের বাবা-মা ভাই-বোন–”
শিউলি বাধা দিয়ে বলল”কেউ নেই। কেউ নেই তার। দূর-সম্পর্কের ফুপুর সাথে থাকে। সেই ফুপু একেবারে আদর করে না।”
রইসউদ্দিন চুপ করে রইলেন। শিউলি অনুনয় করে বলল, “খোকনকে দেখে মায়া পড়ে গেছে চাচা। যে-কয়দিন আমি আছি আমাদের সাথে থাকুক। আমি যখন চলে যাব তখন বল্টু আর খোকনও চলে যাবে।” শিউলি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “আমরা কোনোরকম দুষ্টুমি করব না। খুব ভাল হয়ে থাকব।”
রইসউদ্দিন একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “ঠিক আছে। কিন্তু একটা কথা।”
“কী কথা?”
“এই শেষ। তোমরা আর নতুন কোনো বাচ্চা আমদানি করতে পারবে না। প্রথমে তুমি, তার পরে এসেছে বল্টু। এখন হল খোকন। এইভাবে যদি একজন একজন করে আসতে থাকে তা হলে কয়েকদিন পর এই বাসায় আর আমার থাকার জায়গা থাকবে না।”