চিঠির ভেতরে ছোট চাচার কয়েকটা ছবি। তাঁর স্ত্রী বিদেশি হাসিখুশি একজন আমেরিকান মহিলা, দুজন ছেলেমেয়ে। ছোট চাচার বয়স বেশি নয়, ছবিতে দেখা যাচ্ছে বরফের মাঝে ছেলেমেয়েকে আঁকড়ে ধরে বসে আছেন। চিঠিতে শিউলির কয়েকটা ছবি পাঠানোর জন্য বলেছেন।
রইসউদ্দিন ছোট চাচার চিঠি নিয়ে শিউলিকে ঘুম থেকে ডেকে তুললেন। শিউলি একটু ভয় পেয়ে বলল, “কী হয়েছে চাচা?”
“তোমার ছোট চাচার চিঠি এসেছে।”
শিউলি আনন্দে লাফিয়ে উঠে বলল, “সত্যি?”
“হ্যাঁ। এই দেখা ছবি।”
শিউলি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ছবি দেখল। তার বিদেশি চাচি কী কাপড় পরে আছেন, তার চাচাতো ভাইবোনরা দেখতে কেমন, তার চাচার গায়ের রং কি আরও ফরসা হয়েছে, বরফটা কি একেবারে ধবধবে সাদা, পেছনের গাছে কোনো পাতা আছে কি না–এই ব্যাপারগুলো নিয়ে লম্বা-চাওড়া আলোচনা হল। একটা ছবি যে এত যত্ন করে দেখা যায় সেটা রইসউদ্দিন জানতেন না।
শিউলির চঁচামেচি শুনে বল্টু আর খোকনও ঘুম থেকে উঠে গেছে। তাদের কাছে শিউলি তার ছোট চাচার গল্প করল। আর কিছুদিনের মাঝেই যে ছোট চাচা তাকে আমেরিকা নিয়ে যাবেন আর সে তখন শুধু টিকিস টিকিস করে ইংরেজি বলবে কথাটা সে তাদেরকে কয়েকবার শুনিয়ে দিল। ছোট চাচা তার খরচের জন্যে এক হাজার ডলার পাঠিয়েছেন শুনে শিউলির চোখ বড় বড় হয়ে গেল, এক হাজার ডলার বাংলাদেশী টাকায় কত টাকা সেটা হিসেব করে বের করে বল্টু, খোকন আর শিউলির প্রায় মাথা ঘুরে পড়ে যাবার মতো অবস্থা। ছোট চাচা শিউলির ছবি চেয়েছেন শুনে সাথে সাথেই সেটা কীভাবে করা যায় সেটা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা শুরু হয়ে গেল। বল্টু বলল, “বড় রাস্তার মোড়ে ফটো স্টুডিও আছে। সেখানে গেলেই ছবি তুলে দেবে।”
খোকন মাথা নাড়ল”হ্যাঁ, পেছনে সুন্দর সুন্দর সিনারি থাকে। পানির ফোয়ারা, হরিণ। ফটো তুললে মনে হয় সত্যি সত্যি পানির ফোয়ারার সামনে, হরিণের সামনে ফটো তুলেছে।”
বল্টু বলল, “ফটো তোলার জন্যে টাই ভাড়া পাওয়া যায়।”
শিউলি হি হি করে হেসে বলল, “দূর গাধা। আমি মেয়েমানুষ টাই দিয়ে কী করব?”
রইসউদ্দিন বললেন, “একটা ক্যামেরা থাকলে ভালো হত। তা হলে সুন্দর সুন্দর ছবি তোলা যেত।”
শিউলি জিজ্ঞেস করল, “আপনার ক্যামেরা নাই চাচা?”
রইসউদ্দিন মাথা নাড়লেন, “নাহ্।”
হঠাৎ শিউলির চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, বলল, “চাচা! ছোট চাচা আমেরিকা থেকে যে-টাকা পাঠিয়েছেন সেটা দিয়ে একটা ক্যামেরা কিনে ফেলেন।”
রইসউদ্দিন হেসে ফেললেন, বললেন, “ঠিক আছে! তোমার চাচার টাকাটা তোমার জন্যেই থাকুক, একটা ক্যামেরা আমিই কিনে ফেলি। বাসায় একটা ক্যামেরা থাকা খারাপ না।”
শিউলি, বল্টু আর খোকন আনন্দে চিৎকার করে উঠল।
খোকনের রাতটা কাটিয়েই চলে যাবার কথা ছিল কিন্তু ক্যামেরা কেনা এবং সেটা দিয়ে শিউলির ছবি ভোলা শেষ না হওয়া পর্যন্ত সে থেকে যাওয়া ঠিক করল। ক্যামেরা জিনিসটা সে দূর থেকে দেখেছে কিন্তু কীভাবে ছবি তোলা হয় সেটা কখনো দেখেনি।
তিনজনকে নিয়ে রইসউদ্দিন স্টেডিয়াম মার্কেটে গেলেন, সেখানে দরদাম করে শেষ পর্যন্ত একটা ভালো ক্যামেরা কিনলেন। এখন বাকি রইল শিউলির ছবি তোলা। স্টেডিয়ামের সামনে এক জায়গায় শিউলকে দাঁড় করানো হল, ক্যামেরা চোখে লাগিয়ে যেই ক্লিক করবেন তখন বল্টু বলল, “একটা নতুন জামা হলে ভালো হত।”
রইসউদ্দিন থেমে গেলেন, সত্যিই তাই। তিনি পুরুষমানুষ, সারাজীবন বাচ্চাকাচ্চা থেকে একশো হাত দূরে থেকেছেন, তাদের জামাকাপড় খেয়াল করে দেখেননি। শিউলির রং-ওঠা বিবর্ণ ফ্রকটা দেখে মনে হল সত্যিই এই মেয়েটার একটা নতুন কাপড় হলে চমৎকার হত। শিউলির ছোট চাচা এতগুলো টাকা পাঠিয়েছেন, এখন তার জন্যে তো নতুন জামা-কাপড় কেনাই যায়।
রইসউদ্দিন তখন আবার স্কুটারে চেপে শিউলি, বল্টু আর খোকনকে নিয়ে এলেন এলিফেন্ট রোডে। বাচ্চাদের কাপড়ের দোকান ঘুরে ঘুরে শিউলির জন্যে কাপড়জামা কিনলেন। সাথে আরও দুটি বাচ্চা–তাদের জন্যেও কিনতে হয় কাজেই বল্টু আর খোকনের জন্যেও প্যান্টশার্ট আর জুতো কেনা হল। রইসউদ্দিন বহুদিন জামাকাপড় কেনেননি, বাচ্চা কাচ্চার কাপড় তো একেবারেই কেনেননি, খুব অবাক হয়ে আবিষ্কার করলেন খুব কম দামে বাচ্চাদের জন্যে ভারি সুন্দর সুন্দর জামাকাপড় পাওয়া যায়। দোকানে দোকানে ঘুরে ঘুরে জামাকাপড় কিনতে গিয়ে সবার খিদে লেগে গেল, রইসউদ্দিন তখন সবাইকে নিয়ে গেলেন ফাস্ট ফুডের দোকানে। পেট ভরে হ্যাঁমবার্গার আর পেপসি খেল সবাই।
নতুন জামাকাপড় পরার পর সবার চেহারা একবারে পালটে গেল। রইসউদ্দিন অবাক হয়ে আবিষ্কার করলেন শিউলি মেয়েটির আসলে অপূর্ব মনকাড়া চেহারা, বল্টু এবং খোকনকেও আর পথেঘাটে ঘুরে-বেড়ানো ডানপিটে বাচ্চাদের মতো লাগছে না। তিনজনকে নিয়ে যখন রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন তখন একজন ফিরিওয়ালা রইসউদ্দিনকে থামিয়ে বলল, “স্যার বাচ্চাদের ভালো বই আছে, বই নিবেন? আপনার ছেলেমেয়ের জন্যে নিয়ে নেন।” রইসউদ্দিন তখন চমকে উঠে তিনজনের দিকে তাকালেন। তাদের দেখে সত্যি সত্যি মনে হচ্ছে যে তিনি একজন বাবা, ছুটির দিনে তার তিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে ঘুরতে বের হয়েছেন।