মতলুব মিয়া বিরসমুখে ছেলেটার হাতের বাঁধন খুলে দিল। ছেলেটা হাতে হাত বুলাতে বুলাতে মুরগির খাঁচার কাছে এগিয়ে গেল। মাথা নিচু করে মুরগিটাকে জিজ্ঞেস করল, “এই, তোর নাম কী?
মুরগিটা মাথা উঁচু করে ছেলেটার দিকে তাকাল, কিছু বলল না। ছেলেটা খাঁচা ধরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “ কী নাম?”
সাথে সাথে সবাই স্পষ্ট শুনল মুরগিটা বলল, “জ-রি-না।”
ছেলেটা উঠে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। মতলুব মিয়া হাতে কিল দিয়ে বলল, “শুনেছেন ভাই? শুনেছেন?”
রইসউদ্দিন হতচকিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। শিউলি আর বল্টু খাঁচার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “নাম কী? নাম কী তোর?”
মুরগিটা বারকয়েক কক কক করে হঠাৎ আবার স্পষ্ট গলায় বলল, “জ-রি-না সুন্দরী!”
শিউলি আর বল্টু লাফিয়ে উঠল আনন্দে।
রইসউদ্দিন তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে রইলেন, হঠাৎ করে তাঁর মনে হল তিনি ব্যাপারটা খানিকটা বুঝতে পেরেছেন। তার মুখে একটু হাসি ফুটে ওঠে, একটুকু ছেলে–কিন্তু কী ধুরন্ধর! ছেলেটা মতলুব মিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি যাই।”
রইসউদ্দিন বললেন, “দাঁড়াও ছেলে।”
ছেলেটা শঙ্কিতমুখে দাঁড়িয়ে পড়ল। রইসউদ্দিন জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার নাম কী?”
“কুকন।”
“কুকন? কুকন কি কারও নাম হয়? নিশ্চয়ই তোমার নাম খোকন। তাই না?”
ছেলেটা মাথা নাড়ল। রইসউদ্দিন বললেন, “তুমি নিজের নামটাও ঠিক করে উচ্চারণ করতে পার না আর এরকম ভেন্ট্রিলোকুইজম কেমন করে শিখলে?”
ছেলেটা মাথা ঘুরিয়ে রইসউদ্দিনের দিকে তাকাল। রইসউদ্দিন বললেন, “ভেন্ট্রিলোকুইজম মানে জান? মুখ না নাড়িয়ে কথা বলা যেন মনে হয় অন কেউ কথা বলছে।”
মতলুব মিয়া হঠাৎ চোখ বড় বড় করে সোজা হয়ে দাঁড়াল। নাক দিয়ে ফেস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “কী? কী বলছেন ভাই?”
“তোমার মুরগি কখনো কথা বলে নাই মতলুব মিয়া। কথা বলে খোকন, মনে হয় বলছে মুরগি। তাই যখন খোকন আশেপাশে থাকে না তখন তোমার মুরগিও কথা বলে না।” রইসউদ্দিন খোকনের দিকে তাকালেন, বললেন, “তাই না খোকন?”
খোকনের মুখ হঠাৎ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। সে হঠাৎ উঠে একটা দৌড় দেবার চেষ্টা করল কিন্তু তার আগই মতলুব মিয়া তাকে জাপটে ধরে ফেলেছে। শুধু যে ধরেছে তাই নয় নাকেমুখে কিল-ঘুসি মারা শুরু করেছে। রইসউদ্দিন, শিউলি আর বল্টু একসাথে ছুটে গিয়ে খোকনকে মতলুব মিয়ার হাত থেকে ছুটিয়ে নিল। শিউলি আর বল্টু মিলে মতলুব মিয়াকে ধরে রাখতে পারল না, রাগে ফোঁসফোঁস করে সে হাত-পা নেড়ে চিৎকার করতে করতে বলল, “ব্যাটা বদমাইশ, জোচ্চুর। ঠগের বাচ্চা ঠগ। চোরের বাচ্চা চোর। হারামখোরের বাচ্চা–”
রইসউদ্দিন প্রচণ্ড ধমক দিয়ে বললেন, “মতলুব মিয়া, খবরদার ঘরের মাঝে আজেবাজে কথা বলবে না। এইটুকুন একটা ছেলের গায়ে হাত তোল, তোমার লজ্জা করে না? আরেকবার করেছ কি তোমাকে আমি পুলিশে দেব।”
মতলুব মিয়া গজগজ করতে লাগল, রইসউদ্দিন তখন খোকনকে পরীক্ষা করলেন। নাকে বেকায়দা ঘুসি লেগে খানিকটা রক্ত বের হয়ে এসেছে, রুমাল দিয়ে মুখে মুখ ধুইয়ে দেওয়া হল। বল্টু মগে করে পানি এনে তার মুখ ধুয়ে দিল। শিউলি একগ্লাস লেবুর শরবত তৈরি করে নিয়ে এল। শরবত খেয়ে একটা ঢেকুর
তুলে খোকন বলল, “আমি গেলাম।”
মতলুব মিয়া প্রায় আর্তনাদ করে বলল, “আমার টাকা!” বল্টু দাঁত বের করে হেসে বলল, “তোমার টাকা গেছে মতলুব চাচা।”
শিউলি খোকনের ঘাড়ে থাবা দিয়ে বলল, “কই যাবি? আজ রাতটা আমাদের সাথে থেকে যা।”
“থেকে যাব?”
“হ্যাঁ। তুই কেমন করে ভেন্টি-কুন্টি করিস আমাদের দেখা–”
রইসউদ্দিন হেসে বললেন, “শব্দটা ভেন্টি-কুন্টি না। শব্দটা ভেন্ট্রিলোকুইজম।”
শিউলি কয়েকবার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়ে বলল, “ঐ একই কথা।”
বল্টু রইসউদ্দিনের দিকে তাকিয়ে বলল, “চাচা। খোকন আজ রাতে এখানে থাকুক?”
রইসউদ্দিন একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “ঠিক আছে থাকুক।”
রাত্রিবেলা জরিনা সুন্দরীকে কেটেকুটে রান্না করা হল, মতলুব মিয়ার রান্না খুব যে ভালো হল তা বলা যাবে না, কিন্তু সবাই খেলা খুব তৃপ্তি করে। সবচেয়ে মজা হল খাবার পর, যখন সবার পেটের ভেতর থেকে জরিনা সুন্দরী কথা বলতে শুরু করল! হেসে সবাই কুটিকুটি হয়ে গেল খোকনের কাণ্ড দেখে।
০৬. খোকনের চলে যাবার কথা
০৬.
পরদিন ভোরবেলা খোকনের চলে যাবার কথা। সারারাত ভেন্ট্রিলোকুইজম শুনে শুনে ঘুমাতে অনেক রাত হয়েছে তাই ঘুম থেকে উঠতে সবারই খানিকটা দেরি হল। ঘুম ভাঙতে আরও দেরি হত কিন্তু বিদেশ থেকে কুরিয়ার সার্ভিসে একটা চিঠি এসেছে, সেই লোক দরজা ধাক্কাধাক্কি করে রইসউদ্দিনের ঘুম ভাঙিয়ে দিল।
খাম খুলে রইসউদ্দিন চিৎকার করে শিউলিকে ডাকাডাকি করতে লাগলেন, ভেতরে আমেরিকা থেকে তার ছোট চাচার চিঠি। রইসউদ্দিনকে আমেরিকা থেকে শিউলির ছোট চাচা বিশাল চিঠি লিখেছেন। তিনি খবর পেয়েছিলেন তার ভাই সপরিবারে নৌকাডুবি হয়ে মারা গেছে, শিউলি যে বেঁচে গিয়েছে সেটা তিনি জানতেন না। রইসউদ্দিন যে শিউলিকে দেখেশুনে রাখছেন সেজন্যে ছোট চাচা সারা চিঠিতে কম করে হলেও একশো বার তাকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। ছোট চাচা আমেরিকা থেকে এসে শিউলিকে নিয়ে যাবেন, ভিসার কীসব ব্যাপার আছে সেজন্যে যেটুকু দেরি হবে, তার বেশি একদিনও অপেক্ষা করবেন না। ছোট চাচা লিখেছেন শিউলিকে দেখেশুনে রাখতে রইসউদ্দিনের নিশ্চয়ই খরচপাতি হচ্ছে সেজন্যে তিনি এক হাজার ডলার পাঠালেন। টাকাটা পাঠাতে তাঁর খুব লজ্জা হচ্ছে, কারণ রইসউদ্দিন যে-মানবিক কাজটুকু করেছেন সেটা নিশ্চয়ই টাকা দিয়ে তুলনা করা যায় না।