শিউলি মাথা নেড়ে বলল, “নাম বলেছে কক কক। জরিনা তো বলে নাই।”
রইসউদ্দিন এতক্ষণ একটা কথাও না বলে চুপ করে পুরো ব্যাপারটা দেখছিলেন। এবারে গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, “মতলুব মিয়া!”
“জে?”
“আসলেই তোমার মুরগি কথা বলে?”
“জে ভাই।”
“তোমার নিজের কানে শুনেছ?”
“জে। নিজের কানে শুনেছি।”
“কী কথা বলেছে?”
“নাম জিজ্ঞেস করলে বলে জরিনা সুন্দরী। বাড়ি জিজ্ঞেস করলে বলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া।”
“ব্রাহ্মণবাড়িয়া? রইসউদ্দিন চোখ কপালে তুলে বললেন, “একটা মুরগি ব্রাহ্মণবাড়িয়া বলতে পারে? এত কঠিন একটা শব্দ?”
মতলুব মিয়া গম্ভীর গলায় বলল, “ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মুরগি তো বাড়ি নেত্রকোনা বলতে পারে না।”
“আর কী কী কথা বলে?”
“আলুর পাতা থালু থালু কবিতাটা বলতে পারে।”
“পুরো কবিতাটি বলে?”
“জে।”
রইসউদ্দিন নিঃশ্বাস ফেলে মাথা নাড়লেন। মতলুব মিয়া বলল, “অনেক পাছড়াপাছড়ি করলে গানও গাইতে পারে।”
“গানও গাইতে পারে? কী গান?”
“রঙিলা ভাবি গো–তবে গানের গলা বেশি ভালো না।”
“তুমি নিজের কানে শুনেছ?”
“জে। আপনি শুনবেন ভাই?”
“শোনাও দেখি।”
মতলুব মিয়া খাঁচার সামনে উবু হয়ে বলল, “জরিনা সুন্দরী! একটা গান শোনাও দেখি আমাদের! রঙিলা ভাবির গান! শোনাও! শোনাও দেখি–”
মুরগির গান শোনানোর কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। মতলুব মিয়া খাঁচা ধরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “শোনাও একটা গান। ভালো হবে না কিন্তু! অনেক রাগ হবে কিন্তু! শোনাও গান।”
মুরগি খানিকটা পেয়ে পেয় মাথা উঁচু কর কক কক করে একবার শব্দ করল। মতলুব মিয়া এবারে সত্যি সত্যি রেগে গেল, খাঁচাটা জোরে জোরে কয়েকটা ঝাঁকুনি দিয়ে ধমক দিয়ে বলল, “কথা বল বেটি। বল কথা, না হলে এক আছাড় দিয়ে মাথা ফাটিয়ে দেব, আবাগীর বেটি। মুণ্ডু ছিঁড়ে ফেলব কিন্তু।
রইসউদ্দিন একটা হাই তুলে বললেন, “মতলুব মিয়া, তোমাকে বোকা পেয়ে কেউ একজন ঠকিয়ে দিয়েছে। মুরগি কোনোদিন কথা বলে না। মুরগি যদি কথা বলত তা হলে তুমিও আইনস্টাইন হয়ে যেতে।”
মতলুব মিয়া কাঁদোকাঁদো গলায় বলল, “কিন্তু আমি নিজের কানে কথা বলতে শুনেছি!”
“কী শুনেছ, কীভাবে শুনেছ আমি জানি না–কিন্তু আমার কাছ থেকে তুমি শুনে রেখো, তোমার বুদ্ধি আর ঐ মুরগির বুদ্ধির মাঝে বিশেষ পার্থক্য নাই।”
রইসউদ্দিন ঘুমাতে চলে গেলেন। শিউলি আর বল্টু মতলুব মিয়ার সাথে আরও ঘণ্টাখানেক মুরগিকে কথা বলানোর চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিল। মতলুব মিয়া হাল ছাড়ল না, সারারাত মুরগির পেছনে লেগে রইল। শেষরাতে রইসউদ্দিনের ঘুম যখন একটু হালকা হয়ে এল, শুনতে পেলেন মতলুব মিয়া ভাঙা গলায় কাকুতি-মিনতি করছে, তোর দোহাই লাগে জরিনা বেটি–তোর পায়ে ধরি জরিনা–একটা কথা বল। বেশি লাগবে না, মাত্র একটা শব্দ! মাত্র একটা শব্দ! বল আবাগীর বেটি! বল সোনার চান আমার পিঞ্জিরার পক্ষী! বল একবার চেষ্টা করে দেখ, আমি জানি তুই পারবি। পাঁচশো টাকা দিয়ে তোরে কিনে এনেছি–আমারে তুই পথে বসাবি না। আল্লাহর কসম লাগে–”
সকালবেলা অফিসে যাওয়ার আগে রইসউদ্দিন দেখলেন মতলুব মিয়া মুরগির খাঁচাটিকে সামনে নিয়ে বারান্দায় গালে হাত দিয়ে বসে আছে, মুখে খোঁচাখোঁচা দাড়ি এবং চোখ টকটকে লাল। মতলুব মিয়ার অবস্থা দেখে রইসউদ্দিন তাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। শিউলি স্কুলে যাবার সময় দেখল মতলুব মিয়া হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে আছে। দুপুরবেলা বল্টু যখন হাঁটতে বের হল মতলুব মিয়া তখনও তার মুরগির খাঁচার সামনে বসে আছে।
.
বিকেলবেলা বাসায় ফিরে এসে রইসউদ্দিন একটা বিচিত্র জিনিস দেখতে পেলেন–ঘরের পিলারের সাথে একটা আট-দশ বছরের ছেলে দড়ি দিয়ে বাঁধা। তার সামনে মতলুব মিয়া শিউলি এবং বল্টুকে নিয়ে বসে আছে। মতলুব মিয়ার চেহারা আনন্দে ঝলমল করছে, রইসউদ্দিনকে দেখে সবগুলো দাঁত বের করে হেসে বলল, “ভাই কেস কমপ্লিট।”
“কিসের কেস কমপ্লিট? আর এই ছেলে কে? দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখেছ কেন?”
“পালিয়ে যেন না যায়।”
“পালিয়ে কোথায় যাবে? কী করেছে এই ছেলে?”
“এই হচ্ছে মুরগির ব্যাপারী।”
“যার কাছ থেকে তুমি কথা-বলা মুরগি কিনেছে?”
“জে।”
রইসউদ্দিন অবাক হয়ে সাত-আট বছরের মুরগি-ব্যাপারীর দিকে তাকিয়ে রইলেন। গায়ের রং নিশ্চয়ই একসময় ফরসা ছিল, এখন রোদে পুড়ে বাদামি হয়ে গেছে। চোখ দুটি চকচক করছে, দেখলেই মনে হয় এর পেটে পেটে অনেক বুদ্ধি। রইসউদ্দিন বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুমি মতলুব মিয়াকে মুরগি বিক্রি করেছ?”
ছেলেটা মাথা নাড়ল।
”তুমি নাকি বলেছ তোমার মুরগি কথা বলে?”
ছেলেটা আবার মাথা নাড়ল। রইসউদ্দিন বললেন, “মুরগি তো কখনো কথা বলে না।”
ছেলেটা কোনো কথা না বলে ঠোঁট ওলটাল।
মতলুব মিয়া এগিয়ে এসে বলল, “তুই মুরগিকে আবার কথা বলাতে পারবি? ছেড়ে দেব তা হলে। পারবি?”
ছেলেটা মাথা নাড়ল। মতলুব মিয়া তখন ঘরের ভেতর থেকে মুরগির খাঁচাটা নিয়ে এল, ছেলেটার সামনে রেখে বলল, “নে। কথা বলা।”
ছেলেটা এই প্রথম কথা বলল, “আমাকে আগে ছেড়ে দাও।” মতলুব মিয়া মুখ শক্ত করে বলল, “আগে কথা বলা।”
রইসউদ্দিন ধমক দিয়ে বললেন, “দড়ি খুলে দাও মতলুব মিয়া। একজন মানুষকে আবার বেঁধে রাখে কেমন করে?”