মতলুব মিয়া কাপে করে যে-জিনিসটা চা হিসেবে নিয়ে এল সেটা দেখে অবিশ্যি রইসউদ্দিনের চা খাওয়ার ইচ্ছে পুরোপুরি উবে গেল। ময়লা কাপে ঘোলা খানিকটা তরল, তার মাঝে গোটা ছয়েক নানা আকারের পিঁপড়া ভাসছে। পিঁপড়াগুলো সরিয়ে চায়ে একটু চুমুক দিয়ে তাঁর নাড়ি উলটে এল। থুঃ থুঃ করে
ফেলে বললেন, “এইটা কী এনেছ মতলুব মিয়া? চা, নাকি ইঁদুর মারার বিষ?”
মতলুব মিয়া মুখ গম্ভীর করে বলল, “ভাই, পঁচিশ বছর থেকে আপনার জন্যে জীবনপাত করেছি, এখন আর না।”
রইসউদ্দিন অবাক হয়ে বললেন, “কেন? কী হয়েছে?”
“বাসার কাজ আর করব না।”
রইসউদ্দিন অবাক হয়ে বললেন, “বাসার কাজ তুমি করে করেছ? গত পঁচিশ বছর তো তুমি শুধু শুয়ে বসে কাটিয়ে দিলে। শিউলি আসার পর মনে হয় গতরটা একটু নাড়াচ্ছ।”
মতলব মিয়া মুখ শক্ত করে বলল, “এই অপমান আর সহ্য করব না ভাই, স্বাধীন কাজ করব।”
“কী কাজ?”
“ব্যবসা।”
রইসউদ্দিন চোখ কপালে তুলে বললেন, “ব্যবসা তুমি ব্যবসা করবে?”
“কেন ভাই? আপনি কি মনে করেন আমি ব্যবসা করতে পারি না?”
রইসউদ্দিন গম্ভীরমুখে মাথা নাড়লেন, “আমি তাই মনে করি মতলুব মিয়া। তোমার মতো আলসে মানুষ ব্যবসা করতে পারে না। তুমি কিসের ব্যবসা করবে?”
মতলুব মিয়ার মুখে সবজান্তার মতো একটা হাসি ফুটে ওঠে। সে মাথা নেড়ে বলল, “তার আগে ভাই বলেন দেখি একটা ময়না পাখির দাম কত?”
“ময়না পাখি? সে তো অনেক দাম, কয়েক হাজার তো হবেই।”
”ময়না পাখি তো দেখতে সুন্দর না কিন্তু তার দাম বেশি, কারণটা কী বলেন দেখি?”
“কারণ ময়না পাখি কথা বলে।”
“এখন যদি মনে করেন অন্য কোনো পাখি কথা বলে তবে সেই পাখির দাম কত হবে?”
রইসউদ্দিন অবাক হয়ে মতলুব মিয়ার দিকে তাকালেন, “তুমি যদি কথা বলা কাক আনতে পার লাখ টাকায় বিক্রি হবে। যদি মুরগিকে দিয়ে কথা বলাতে পার সেইটাও নিশ্চয়ই বৈজ্ঞানিকরা লাখ দুইলাখ টাকায় কিনে নেবে।”
মতলুব মিয়ার চোখ লোভে চকচক করতে থাকে, “সত্যি? সত্যি? ভাই?”
রইসউদ্দিন মাথা নেড়ে বললেন, “কিন্তু তুমি কী পাখি আনবে যেটা কথা বলে?”
মতলুব মিয়া উত্তর না দিয়ে খুব গম্ভীর গলায় বলল, “সময় হলেই দেখবেন ভাই। এখন খালি আমার দরকার একটু ক্যাশ টাকা। ধার দিবেন কিন্তু ভাই।”
রইসউদ্দিন ভুরু কুঁচকে বললেন, “দেওয়ার মতো হলে নিশ্চয়ই দেব কিন্তু কথা হচ্ছে তোমার যেরকম বুদ্ধিশুদ্ধি তোমাকে কেউ-না ঠকিয়ে দেয়!”
মতলুব মিয়া একগাল হেসে বলল, “ভাই, একজন মানুষকে আরেকজন মানুষ ঠকাতে পারে যদি তার বুদ্ধি বেশি হয়। এইখানে মক্কেলের বুদ্ধি আমার থেকেও কম। হে হে হে!”
সেদিন সন্ধ্যেবেলা দেখা গেল মতলুব মিয়া একটা খাঁচা নিয়ে এসেছে, খাঁচাটা কালো কাপড় দিয়ে ঢাকা। অনেক যত্ন করে সেটাকে তার ঘরে টেবিলের উপর রাখা হল। রইসউদ্দিন জিজ্ঞেস করলেন, “কী আছে ভেতরে?”
মতলুব মিয়া গম্ভীরমুখে বলল, “সময় হলেই দেখবেন।”
“কখন সময় হবে?”
“রাত বারোটায়।”
“রাত বারোটায়? রাত বারোটায় কেন?”
“পাখিদের খাওয়া-দাওয়া বিশ্রাম খুব নিয়মমতো নিতে হয়। একটু উলটা পালটা হলেই বিপদ।”
শিউলি জিজ্ঞেস করল, “এর ভিতরে পাখি আছে?”
“হুঁ।“
“এই পাখি কথা বলে?”
মতলুব মিয়া উত্তর না দিয়ে খুব একটা তাচ্ছিল্যের ভান করে শিউলির দিকে তাকাল। বল্টুকে এখনও স্কুলে দেওয়া হয়নি কিন্তু একা একা জেগে না থেকে সেও শুয়ে পড়ে। তবে আজকে কথা বলা পাখি দেখার জন্যে রইসউদ্দিন, শিউলি এবং বল্টু তিনজনই জেগে রইল। ঠিক রাত বারোটার সময় মতলুব মিয়া এক গ্লাস পানি, একটা পিরিচে করে কিছু চাউল এবং একটা মোমবাতি নিয়ে হাজির হল। টেবিলে মোমবাতিটা জ্বালিয়ে সে ঘরের লাইট নিভিয় দিল। বল্টু জিজ্ঞেস করল, “লাইট থাকলে কী হয়?”
মতলুব মিয়া ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বলল, “শ-স-স-স কোনো শব্দ না। এই পাখিকে জাগানোর সময় কড়া আলো কড়া শব্দ থাকতে পারবে না।”
রইসউদ্দিন, শিউলি এবং বল্টু তিনজনই নিঃশ্বাস বন্ধ করে রইল এবং মতলুব মিয়া খুব সাবধানে কালো কাপড়টি সরিয়ে নিল। তারা অবাক হয়ে দেখল খাঁচার মাঝখানে একটা মাঝারি সাইজের মুরগি বসে আছে। কথা বলা নিষেধ জেনেও শিউলি অবাক হয়ে চিৎকার করে উঠল, “আরে! এইটা দেখি মুরগি!”
মতলুব মিয়া চোখ পাকিয়ে শিউলির দিকে তাকিয়ে বলল, “চুপ!”
শিউলি চুপ করে যাবার পর মতলুব মিয়া গ্লাস থেকে ঠাণ্ডা পানি নিয়ে মুরগির গায়ে ছিটিয়ে দিতেই মুরগি গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে বসল। মতলুব মিয়া তখন হাতে কয়টা চাউল নিয়ে খাঁচার দরজা দিয়ে ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দিল, কিন্তু মুরগি সেটা খাবার কোনো উৎসাহ দেখাল না, খাঁচার এক কোণায় সরে গেল। মতলুব মিয়া বলল, “খাও জরিনা একটু চাউল খাও।”
বল্টু জিজ্ঞেস করল, “মুরগি কথা বলতে পারে?”
“হ্যাঁ।” মতলুব মিয়া মাথা নাড়ল, “মুরগি বোলো না, মনে দুঃখু পাবে। নাম জরিনা।”
“মুরগির নাম জরিনা?”
“হ্যাঁ। সব কথা বলতে পারে।” মতলুব মিয়া মুরগির দিকে তাকিয়ে আদুরে গলায় বলল, “বলো জরিনা, নাম বলো।”
সবাই কানখাড়া করে রইল, মুরগি কোনো শব্দ করল না। মতলুব মিয়া গলায় মধু ঢেলে বলল, “বলো জরিনা সুন্দরী! লজ্জা কোরো না।”
মুরগি এবারের কক কক করে একটু শব্দ করল। বল্টু হাততালি দিয়ে বলল, “বলেছে! নাম বলেছে।”