মতলুব মিয়া মোটামুটি নিশ্চিত ছিল বল্টুর সারা শরীর ভালো করে খুঁজলেই মানিব্যাগটা পাওয়া যাবে, না পেয়ে সেও খুব চিন্তিত হয়ে গেল। শিউলি কাছেই দাঁড়িয়েছিল, সে বল্টুর দিকে তীক্ষ্ণচোখে তাকিয়ে থাকে। বল্টু উদাস-উদাস চোখে শিউলির দিকে তাকাল এবং হঠাৎ তার চোখে একটা দুষ্টুমির হাসি ঝিলিক মেরে যায়। সাথে সাথে পুরো ব্যাপারটা শিউলির কাছে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে যায়। সে মুখ টিপে হেসে এক পা এগিয়ে এসে বলল, “রইস চাচা।”
“কী হল?”
”আপনার মানিব্যাগ তো এই ঘরেই ছিল?”
“চুরি হলে তো এই ঘর থেকেই চুরি হয়েছে?”
“হুঁ।“
“চোর তা হলে এই ঘরেই আছে?”
“কী বলছ তুমি?”
“বলছিলাম কি মতলুব চাচাকে–”
মতলুব মিয়া চিৎকার করে লাফ দিয়ে উঠে বলল, “কী বললে ছেমড়ি? তোমার এত বড় সাহস!”
“আপনার পকেট দেখি!”
মতলুব মিয়া রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে পকেটে হাত দিল এবং হঠাৎ সে একেবারে পাথরের মতো জমে গেল। তার মুখ প্রথমে ছাইয়ের মতো সাদা এবং একটু পরে সেখানে ছোপ ছোপ ছোট লাল এবং বেগুনি রং দেখা গেল। রইসউদ্দিন অবাক হয়ে বললেন, “কী হয়েছে মতলুব মিয়া?”
“আম-আ-আ-আম–”
“আম?”
“আমা-আমার আমার প-প-পকেট–”
”তোমার পকেটে কী?”
“আ-আ-আ আপনার মানিব্যাগ।”
মতলুব মিয়া সত্যি সত্যি তার পকেট থেকে রইসউদ্দিনের মানিব্যাগ বের করে আনল। রইসউদ্দিন খুব অবাক হয়ে ভুরু কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন। মতলুব মিয়া তোতলাতে তোতলাতে বলল, “কে-কে কেমন করে আ
আ আমার পকেটে এল!”
রইসউদ্দিন মেঘস্বরে বললেন”মতলুব মিয়া!”
“জে?”
“মানিব্যাগের তো পাখা নাই যে উড়ে উড়ে তোমার পকেটে চলে গেছে! নাকি আছে?”
“নাই।”
“তুমি কী উদ্দেশ্যে এইটা পকেটে ঢোকালে? আর কী উদ্দেশ্যে এই ছেলেটাকে চোর প্রমাণ করার জন্যে এত ব্যস্ত হলে?”
মতলুব মিয়া তোতলাতে লাগল, “ভাই, বি-বি-বিশ্বাস করেন, আ-আ-আমি কিছু জানি না।”
“তোমার পকেটে আমার মানিব্যাগ আর কিছু কিছু জান না?”
“খো-খো-খোদার কসম।”
“তোমার টাকার দরকার থাকে তো আমাকে বললে না কেন? আমার মানিব্যাগ কেন সরিয়ে নিলে?”
“খো-খো-খোদার কসম ভাই।”
“খবরদার মতলুব মিয়া, চুরি-চামারি করে আল্লাহ খোদার নাম টানাটানি শুরু কোরো না।”
শিউলি মুখ টিপে হেসে বলল, “আপনি কোনো চিন্তা করবেন রইস চাচা। আমরা সবসময় মতলুব চাচাকে চোখে-চোখে রাখব, মতলুব চাচা আর চুরি চামারি করতে পারবে না।”
মতলুব মিয়া বিস্ফারিত চোখে শিউলির দিকে তাকিয়ে রইল। শিউলি বলল, “রাত্রিবেলা মতলুব চাচাকে তালা মেরে রাখলে কেমন হয় রইস চাচা?”
.
ঘুমানোর সময় শিউলি বল্টুর ঘাড় ধরে বলল, “বল্টু!”
বল্টু ঘাড় ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “ঘাড়ে কেন ধরেছ? শিউলি, ঘাড় ছাড়ো।”
“খবরদার, শিউলি বলবি তো ঘাড় ভেঙে দেব। বল শিউলি আপা।”
“ঘাড় ছাড়ো শিউলি আপা।”
“ছাড়ছি, তার আগে বল–আর কখনো চুরি করবি?”
“কখন চুরি করলাম?”
“এই যে মানিব্যাগ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় সরালি!”
“সেইটা কি চুরি হল? এইটা করলাম মতলুব চাচাকে টাইট দেওয়ার জন্যে।”
“ঠিক আছে, কিন্তু আর কখনো করবি না।”
“করব না।”
“বল খোদার কসম।”
“খোদার কসম।”
“বল শান্নি পীরের কসম।”
বল্টু কিছু না বলে চুপ করে রইল। শিউলি একটা ধমক দিয়ে বলল, “বল!”
বল্টু বিড়বিড় করে বলল, “শান্নি পীরের কসম।”
“এখন কাছে আয়।” বল্টু কাছে আসতেই শিউলি হ্যাঁচকা টানে তার গলার তাবিজটা ছিঁড়ে নিল। বল্টু প্রায় আর্তনাদ করে বলল, “আমার তাবিজ!”
“তোর আর এই তাবিজের দরকার নাই বল্ট। তুই আর কোনোদিন চুরি করবি না।”
বল্টু একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলল, এই মেয়েটা সত্যি সত্যি তার এতদিনের ব্যবসাটার একেবারে বারোটা বাজিয়ে দিল। শান্নি পীরের কসম খেয়ে তাবিজ ছাড়া সে কি আর কখনো পকেট মারতে পারবে? অনেক দুঃখ নিয়ে বল্টু সেই রাতে ঘুমাতে গেল।
০৫. একটু সুস্থ হয়েই বল্টু চলে যাবে
০৫.
একটু সুস্থ হয়েই বল্টু চলে যাবে বলে কথা দিয়েছিল কিন্তু এর মাঝে দুই সপ্তাহ পার হয়ে গেছে বল্টু চলে যাবার ব্যাপারে কোনো আগ্রহ দেখাচ্ছে না। রইসউদ্দিন নিজে থেকে কিছু বলতেও পারেন না, এইটুকুন একটা ছেলেকে তো আর ঘর থেকে বের করে দেওয়া যায় না। ছেলেটা আসায় শিউলির একটা কথা বলার লোক হয়েছে, দুইজনে কুটকুট করে দিনরাত কথা বলে। মেয়েটা অসম্ভব দুষ্ট হলেও ভেতরে কেমন জানি একটা মায়া আছে, মনে হয় ছেলেটাকে একটু আদরও করে। বল্টু বাসায় থাকায় রইসউদ্দিন আরেকটা লাভ হয়েছে, মতলুব মিয়াকে চোখে-চোখে রাখার একজন মানুষ হয়েছে। পঁচিশ বছর একসাথে থেকে হঠাৎ সে যে চুরি করা শুরু করবে সেটা কে জানত? সবচেয়ে বড় কথা, শিউলির চাচার খোঁজ পাওয়া গেছে, রইসউদ্দিন চিঠি লিখেছেন, আশা করছেন সপ্তাহ দুয়েকের মাঝে চিঠির উত্তর এসে যাবে। চাচা এসে যখন মেয়েটাকে নিয়ে যাবে তখন বল্টু তার নিজের জায়গায় চলে যাবে। ততদিন তার বাসায় এই দুজন নতুন বাচ্চা অতিথি থাকা এমন কিছু খারাপ ব্যাপার নয়। বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে তাঁর যেরকম ভয় ছিল–সত্যি কথা বলতে কী এ দুজনকে দেখে সেই ভয়টা একটু কমেই এসেছে।
আজ অফিস ছুটি। রইসউদ্দিন তার কাগজপত্র ঝেড়েঝুড়ে পরিষ্কার করার জন্যে বের করে খানিক দূর এগিয়ে এসে হঠাৎ করে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছেন। শিউলি আর বল্টু বেরিয়ে গেছে–দুজন টো টো করে কোথায় ঘুরে বেড়ায় কে জানে! কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে রইসউদ্দিন হঠাৎ চা খাওয়ার ইচ্ছে করল। মতলুব মিয়াকে ডেকে তাই এক কাপ চা দিয়ে যেতে বললেন।