যখন তিনি কলেজে পড়েন তখন পাড়ার বাচ্চাকাচ্চারা মিলে ঠিক করল তারা একটা নাচগানের অনুষ্ঠান করবে। রইসউদ্দিনের উপর ভার পড়ল স্টেজে আলোর ব্যবস্থা করে দেওয়ার। ইলেকট্রিক তার টেনে রইসউদ্দিন যখন সকেট লাগাচ্ছেন তখন এক দুষ্টু ছেলে এসে সেই তার প্লগের মাঝে ঢুকিয়ে দিল, ইলেকট্রিক শক খেয়ে রইসউদ্দিন একেবারে আঁ আঁ আঁ চিৎকার করে দশ হাত দূরে ছিটকে পড়লেন। তাই দেখে পাড়ার বাচ্চাকাচ্চাদের সে কী আনন্দ-মুখে হাত দিয়ে তাদের সে কী খিকখিক হাসি!
বছরখানেক আগে তাঁর এক বন্ধু বউ-বাচ্চাকে নিয়ে রইসউদ্দিনের বাসায় বেড়াতে এসেছিল। বাচ্চাটার বয়স পাঁচ বছর, ফুটফুটে চেহারা, মুখে নিষ্পাপ একটা ফেরেশতা ফেরেশতা ভাব, কিন্তু তার কাজকর্ম ছিল একেবারে ইবলিশের কাছাকাছি। ঘরে ঢুকেই শেলফ থেকে তাঁর প্রিয় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের মূর্তিটা টেনে ফেলে দিল, কবিগুরুর কপাল এবং নাক গেল একদিকে, দাড়ি এবং গোঁফ অন্যদিকে। দুপুরবেলা রইসউদ্দিন দামি ফাউন্টেন পেনটাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে তার বাম চোখটা গেলে দেওয়ার চেষ্টা করল, চোখে চশমা ছিল বলে চোখটা বেঁচে গেলেও গালের কাছাকাছি খানিকটা চামড়া উঠে গেল। তাঁর নিজের বড় ক্ষতি না হলেও দামি ফাউন্টেন পেনটার একেবারে বারোটা বেজে গেল। খাবার সময় হলে ছেলেটা ধনুকের মতো বাঁকা হয়ে ষাড়ের মতো চিৎকার করতে শুরু করল। এইটুকু মানুষ কীভাবে এত জোরে চিৎকার করে ভেবে রইসউদ্দিন একেবারে হতবাক হয়ে গেলেন। কোনোভাবে তাকে শান্ত করতে না পেরে তার হাতে একটা লাল মার্কার দেওয়া হল। সেই মার্কার দিয়ে কিছুক্ষণের মাঝেই সে সবকয়টি ঘরের দেয়ালের যেটুকু নাগাল পেল সেটুকুতে ছবি এঁকে ফেলল। বাচ্চাটি আর তার বাবা-মা রইসউদ্দিনের বাসায় ছিল তিন দিন, সেই তিন-দিনকে রইসউদ্দিনের মনে হল তিন বছর এবং এই সময়ে তার বাচ্চাভীতি বেড়ে গেল আরও তিনগুণ!
শুধু যে এই বাচ্চাটিই তার মাঝে ভয় ঢুকিয়ে গেছে তাই নয়, অবস্থা দেখে মনে হয় পৃথিবীর সব বাচ্চাই যেন ষড়যন্ত্র করে তার পেছনে লেগে গেছে। রেস্টুরেন্টে চা খেতে গেলে বাচ্চা বয়-বেয়ারারা সবসময় তার কোলে খানিকটা গরম চা ফেলে দেয়। দোকানে কেনাকাটা করতে গেলে ছোট ছোট বাচ্চা মনে হয় ইচ্ছে করেই তার পায়ের তলায় চাপা পড়ার চেষ্টা করে। তাদের বাঁচাতে গিয়ে রইসউদ্দিন নিজে আছাড় খেয়ে পড়েন কিন্তু সেই বাচ্চাদের কখনো কিছু হয় না এবং তাকে আছাড় খেতে দেখে বাচ্চারা উলটো আনন্দে হাততালি দিতে থাকে। রাস্তার পাশে যেসব ছোট ছোট বাচ্চা ইট ভাঙে রইসউদ্দিন যখন তাদের পাশ দিয়ে হেঁটে যান তখন অবধারিতভাবে সেইসব ছোট বাচ্চা হাতুড়ি দিয়ে তাঁর পায়ের নখকে অল্পবিস্তর থেঁতলে দেয়।
একদিন অন্যমনস্কভাবে রিকশায় উঠেছেন, খানিক দূর যাবার পর হঠাৎ ভালো করে তাকিয়ে দেখেন রিকশা চালাচ্ছে একেবারে বাচ্চা একটা ছেলে। রইসউদ্দিন আঁতকে উঠে বললেন, “থামাও–রিকশা থামাও!” তার আগেই সেই রিকশা নিয়ে ছেলেটি রইসউদ্দিনকে রাস্তার পাশে নর্দমায় ফেলে দিল। দেখতে দেখতে তখন তাঁকে ঘিরে ভিড় জমে উঠল এবং এরকম বুড়ো ধামড়া একজন মানুষ যে এত ছোট একটা বাচ্চাকে দিয়ে রিকশা চালিয়ে নিচ্ছে সেইজন্যে সবাই মিলে তাঁকে যাচ্ছেতাই ভাষায় গালিগালাজ শুরু করল।
সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপারটি ঘটেছে মাত্র মাসখানেক আগে। একটা মনোহরী দোকান থেকে রইসউদ্দিন চায়ের প্যাকেট কিনেছেন, হঠাৎ দেখলেন ছোট একটা বাচ্চাও তার বাবা-মায়ের সাথে দোকানে এসেছে। ফুটফুটে বাচ্চা হাঁটিহাঁটি পায়ে দোকানে ঘুরছে, রইসউদ্দিনের দিকে তাকাতেই তিনি দ্রতা করে মুখে একটা হাসিহাসি ভাব করলেন। সাথে সাথে বাচ্চার সেকি চিৎকার! তার বাবা-মা ভয় পেয়ে ছুটে এসে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে বাবা?”
ফুটফুটে বাচ্চাটি রইসউদ্দিনকে দেখিয়ে বলল, “ছেলেধরা!”
সাথে সাথে তাঁকে নিয়ে কী সাংঘাতিক অবস্থা! শুধুমাত্র মানুষটা ভয়ংকর সাহসী বলে কেউ তাঁর গায়ে হাত দিতে পারেনি, কিন্তু পুরো একদিন তাঁর থানা হাজতে থাকতে হল। কাজেই রইসউদ্দিন যদি ছোট বাচ্চাদের ভয় করেন, তা হলে তাঁকে খুব একটা দোষ দেওয়া যায় না।
এই রইসউদ্দিন কাছে একদিন একটা চিঠি এল। চিঠিটা এরকম :
প্রিয় রাইচউদ্দিন,
সালাম পর সমাচার এই যে, আপনাকে বিশেষ প্রয়োজনে পত্র লিখিতেছি। আপনি নিশ্চয়ই অবগত আছেন যে, আপনার ভাই জনাব জমিরউদ্দিন নৌকাডুবিতে সপরিবারে ইনতিকাল করিয়াছেন। তাহার নয় বৎসরের কন্যা শিউলি ঘটনাক্রমে বাঁচিয়া গিয়াছে। এই এতিম বালিকাটি গত ছয়মাস যাবৎ আমার সহিত বসবাস করিতেছে। আমি কিছু বলিতে চাহি না আবার না বলিয়াও পারিতেছি না যে, এই বালিকাটি অত্যন্ত দুষ্ট প্রকৃতির। সে আমার পরিবারে বিশেষ অশান্তির সৃষ্টি করিয়াছে। তাহার সহিত মিশিয়া আমার পুত্র ও কন্যাও বখিয়া যাইবার উপক্রম হইয়াছে। পত্রপাঠ মারফত তাহাকে লইয়া যাইবার জন্য আপনাকে বিশেষভাবে অনুরোধ করিতেছি।
আরজ গুজার
মোল্লা কফিলউদ্দিন বি. এ. বি. টি.
.
মোল্লা কফিলউদ্দিন বি. এ. বি. টি.-র চিঠি পড়ে রইসউদ্দিন খুব সাবধানে বুক থেকে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস বের করে দিলেন। তার নাম রাইচউদ্দিন না (তার ধারণা কারও নাম রাইচউদ্দিন হওয়া সম্ভবও নয়), তার জমিরউদ্দিন নামে কোনো ভাই নেই এবং নয় বছরের কোনো ভাইঝিও নেই। কাজেই এত অল্প বয়সে বাবা মা মারা যাওয়া এই বাচ্চা মেয়েটার জন্যে তার একটু দুঃখ লাগলেও তার কিছু করার নেই। সত্যি কথা বলতে কি, এই দুষ্টু মেয়েটা এসে তার ঘাড়ে চেপে বসবে চিন্তার করেই রইসউদ্দিনের মনটা খুশি হয়ে ওঠে। চিঠিটা ভুল করে তার কাছে চলে এসেছে। পরদিন দুপুরবেলা তিনি পিয়নকে চিঠিটা ফেরত দিয়ে সত্যিকারের রাইচউদ্দিনের কাছে পৌঁছে দিতে বললেন।