“দুই নম্বুরি রান্না।”
মতলুব মিয়া মেঘস্বরে জিজ্ঞেস করল, “সেটা আবার কী?”
“যেই রান্না মুখে নেওয়া যায় সেইটা এক নম্বুরি, যেইটা মুখে নেওয়া যায় না সেইটা হচ্ছে দুই নম্বুরি।–”
শিউলি বলল, “কষ্ট করে খেয়ে নাও। মতলুব চাচা নাকি পঁচিশ বছর ধরে এই রান্না শিখেছে।”
রইসউদ্দিন ভাত খেতে খেতে বল্টুর খোঁজ-খবর নিলেন, মা-বাবা ভাই-বোন কেউ নেই, একেবারে একা থাকে শুনে জিব দিয়ে চুকচুক করে শব্দ করলেন। পড়াশোনা কিছু করেছে কি না জানতে চাইলে বল্টু বলল, “এমনিতে স্কুলে যাই নাই, কিন্তু ওস্তাদজির কাছে কিছু জিনিসপত্র শিখেছি।”
শিউলি খেতে খেতে বিষম খেল। ওস্তাদজির কাছে কী বিদ্যা শিখেছে ব্যাখ্যা করলে বিপদ হয়ে যাবে। রইসউদ্দিন জিজ্ঞেস করলেন, কী শিখেছে ওস্তাদের কাছে?”
“এই–হাতের কাজ।”
মতলুব মিয়া সরুচোখে বলল, “কীরকম হাতের কাজ?”
বল্টু কিছু বলার আগেই রইসউদ্দিন বললেন, “আজকাল কতরকম এন. জি. ও. আছে, মেয়েদের কাজকর্ম শেখায়, বাচ্চাদের কাজকর্ম শেখায়। ঠোঙা বানানো, টুকরি বানানো এইসব হবে আর কি!”
বল্টু কিছু বলল না, কিন্তু শিউলি জোরে জোরে কয়েকবার মাথা নাড়ল। রইসউদ্দিন বর দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোমার হাতের কাজ কোথায় দেখাও?”
“আমাদের ওস্তাদের সাগরেদরা একেকজন একেক জায়গায় যাই। কেউ রেলস্টেশন, কেউ বাসস্টেশন। আমি বাসস্টেশনে যাই।”
“ঠিক নাই। কখনো বেশি কখনো কম।”
বল্টু হাল ছেড়ে দেবার ভঙ্গি করে মাথা নেড়ে বলল, “আজকাল মানুষজন পকেটে টাকা-পয়সা নিয়ে বের হয় না।”
.
রাত্রে খাবারের পর শিউলি পড়তে গেল, তার নাকি অনেক হোমওয়ার্ক বাকি। বল্টর কিছু করার নেই তাই সে বাসায় ঘুরে বেড়াতে থাকে। বসার ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই শুনতে পেল ভেতরে রইসউদ্দিন সাথে মতলুব মিয়া কথা বলছে। বল্টু চলে আসছিল কিন্তু হঠাৎ থেমে গেল মনে হল তাকে নিয়ে কথা হচ্ছে। শুনতে পেল মতলুব মিয়া বলছে, “ভাই, আমি লাখ টাকা বাজি ধরতে পারি এই ব্যাটা চোর।”
রইসউদ্দিন বললেন, “এইটুকু মানুষ চোর?”
“চোরের বয়স নাই ভাই, চোরের সাইজও নাই। যারা চোর তারা জন্ম থেকে চোর।”
“কী বলছ বাজে কথা!”
“আমার কথা বিশ্বাস করলেন না? পোলাটার চোখের দৃষ্টি দেখেন নাই?”
“আমার তো এমন কিছু উনিশ-বিশ মনে হল না।”
মতলুব মিয়া ষড়যন্ত্রীর মতো গলা নিচু করে বলল, “একে বাসার মাঝে জায়গা দেবেন না ভাই। সর্বনাশ করে দেবে।”
“কী রকম সর্বনাশ করবে?”
“এদের বড় বড় চোর-ডাকাতদের সাথে যোগাযোগ থাকে, রাত্রিবেলা দরজা খুলে সবাইকে নিয়ে আসবে।”
রইসউদ্দিন হোহো করে হেসে বললেন, “আমার বাসায় আছে কী যে চোর ডাকাত আসবে?”
মতলুব মিয়া গম্ভীর গলায় বলল, “এইটা হাসির কথা না ভাই। যদি ভালো চান তা হলে এই ছেলেকে বিদায় করেন।”
রইসউদ্দিন বললেন, “ছি ছি! এটা তুমি কী বলছ মতলুব মিয়া! অসুস্থ একটা ছেলে এসেছে, তাকে ঘর থেকে বের করে দেব? শরীর ভালো হলে সে তো নিজেই চলে যাবে।”
“ঠিক আছে, যদি বের করতে না চান তা হলে রাত্রে ঘরে তালা মেরে রাখবেন। ছোটলোকের জাতকে বিশ্বাস নাই।”
রইসউদ্দিন এবারে একটু রেগে উঠে ধমক দিয়ে বললেন, মতলুব মিয়া, তুমি বড় বাজে কথা বল, এখনও যাও দেখি!”
মতলুব মিয়া ঘর থেকে বের হওয়ার আগেই বল্টু দরজা থেকে সরে যাবার চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। তাকে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মতলুব মিয়া বিশাল হৈচৈ শুরু করে দিল, “এই ছেলে, তুমি এইখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন?”
বল্টু মিয়া উদাস-উদাস গলায় বলল, “তা হলে কোনখানে থাকব?”
“কত বড় সাহস তুমি লুকিয়ে লুকিয়ে আমার প্রাইভেট কথাবার্তা শোন।”
বল্টু কিছু বলল না–কী বলবে ঠিক বুঝতেও পারল না। মতলুব মিয়া চিৎকার করে বল্টুর হাত ধরে রইসউদ্দিনের কাছে নিয়ে গেল, “ভাই, বলেছিলাম
এই ছেলে চোরের জাত? এই দেখেন দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সব কথা শুনছে।”
রইসউদ্দিন আমতা আমতা করে বললেন, “শুনলে সমস্যাটা কী?”
“সমস্যা বুঝতে পারছেন না? মাথায় বদ মতলব সেইজন্যে চোরের মতো কথাবার্তা শুনছে।”
মতলুব মিয়ার হৈচৈ চিৎকার শুনে শিউলিও চলে এসেছে, সে একটু অবাক হয়ে বলল, “কী হয়েছে?”
মতলুব মিয়া বলল, “তুমি কোথা থেকে এই ছেলে ধরে এনেছ? পরিষ্কার চোর।”
শিউলি ঘাবড়ে গেল, ভয়ে ভয়ে বলল, “কী চুরি করেছে?”
“এখনও করে নাই, কিন্তু মনে হয় করবে।” মতলুব মিয়া মুখ শক্ত করে রইসউদ্দিনকে বলল, “ভাই আপনার টাকা-পয়সা মানিব্যাগ সাবধান।”
রইসউদ্দিন মতলুব মিয়াকে একটা কঠিন ধমক দিতে গিয়ে হঠাৎ থেমে গেলেন। বল্টু যে-টেবিলের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে সেখানে একটু আগে তার মানিব্যাগটা ছিল, এখন নেই। রইসউদ্দিন চমকে উঠে বললেন, “আমার মানিব্যাগ!”
মতলুব মিয়া দুই লাফ দিয়ে বল্টুকে ধরে ফেলল, চিৎকার করে বলল, “বের কর মানিব্যাগ।”
“মানিব্যাগ? কোন মানিব্যাগ?”
মতলুব মিয়া দাঁত-কিড়মিড় করে বলল, “ঢং করবি না ব্যাটা বদমাইশ। তোদেরকে আমি হাড়ে-হাড়ে চিনি।”
রইসউদ্দিন কিছু বলার আগেই মতলুব মিয়া বল্টুর ঢলঢলে পোশাকের ভেতরে সবকিছু দেখে ফেলেছে, কোথাও মানিব্যাগ লুকানো নেই। টেবিলে, টেবিলের নিচে আশপাশে আবার খুঁজে দেখা হল, মানিব্যাগের কোনো চিহ্ন নেই। রইসউদ্দিন কয়েকবার নিজের পকেট দেখলেন, ভুল করে ড্রয়ারের মাঝে রেখে দিয়েছেন কি না ভেবে ড্রয়ারটা খুলে দেখলেন এবং কোথাও না পেয়ে সত্যি সত্যি খুব দুশ্চিন্তিত হয়ে গেলেন। মাত্র বেতন পেয়েছেন, মানিব্যাগ-ভরা টাকা, তা ছাড়া নানারকম দরকারি কাগজপত্র রয়েছে, এখন এই মানিব্যাগ চুরি হয়ে গেলে তার মহা ঝামেলা হয়ে যাবে।