“আমি রেখেছি।”
“কখন রেখেছ?”
“তুমি যখন আমার কাছে দৌড়ে এসেছ তখন।”
ছেলেটা আবার পিচিক করে থুতু ফেলে বলল, “ম্যানিব্যাগটা সরাতে না পারলে কপালে দুঃখ ছিল।”
শিউলি চোখ লাল করে বলল, “আর যদি কেউ দেখত মানিব্যাগ আমার ব্যাগের ভিতরে রাখছ?”
ছেলেটা উদাস-উদাস মুখে বলল, “তা হলে তোমার কপালেও দুঃখ ছিল।”
শিউলি হতবাক হয়ে ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। ছেলেটা বলল, “মানিব্যাগটাও দাও, আমি যাই।”
“কী করবে মানিব্যাগ দিয়ে?”
“দেখি লাভ হল নাকি লোকসান হল। দিনকাল খুব খারাপ। আজকাল মানুষ পকেটে টাকা-পয়সা বেশি রাখে না।”
শিউলি আর ছেলেটা হাঁটতে হাঁটতে রাস্তার মোড়ে এসে হাজির হয়েছে, সেখানে দুজন ট্রাফিক পুলিশ কথা বলছে। কাছেই মোটরসাইকেলে একজন পুলিশ অফিসার বসে। ছেলেটা পুলিশকে ভয় পায় মনে হল, তাদেরকে দেখেই হঠাৎ করে কেমন জানি একেবারে সিটিয়ে গেল। শিউলির কী মনে হল কে জানে, হঠাৎ সে পুলিশগুলোর কাছে গিয়ে বলল, “এই যে, শোনেন।”
মোটরসাইকেলে বসে থাকা-পুলিশ অফিসার বললেন, “কী হল খুকি?”
শিউলি তার স্কুলব্যাগে হাত ঢুকিয়ে মানিব্যাগটা বের করে পুলিশ অফিসারের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “এই যে এইটা রাস্তায় পড়েছিল।”
পুলিশ অফিসারটা মানিব্যাগটা হাতে নিয়ে শিস দেবার মতো শব্দ করে বললেন, “সর্বনাশ! অনেক টাকা ভেতরে!”
শিউলি জিজ্ঞেস করল, “ঠিকানা আছে ভেতরে?”
পুলিশ অফিসার মানিব্যাগের কাগজপত্র দেখে বললেন, “আছে মনে হচ্ছে।”
“মানিব্যাগটা পৌঁছে দেওয়া যাবে?”
“অবশ্যি পৌঁছে দেওয়া যাবে। তোমার নাম কী খুকি?”শিউলি।”
“আর তোমার?” বলে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে পুলিশ অফিসার হঠাৎ চমকে উঠলেন, “সে কী! তোমার একী অবস্থা!”
ছেলেটা কিছু বলার আগেই শিউলি বলল, “রিকশায় ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেছে।”
একজন ট্রাফিক পুলিশ দাঁত-কিড়মিড় করে বলল, “এই ব্যাটা রিকশাওয়ালাদের যন্ত্রণায় মরেও শান্তি নেই!”
পুলিশ অফিসার বললেন, “এসো আমার সাথে।”
ছেলেটা ভয়ে ভয়ে বলল, “কোথায়?”
“ডাক্তারখানায়।”
ছেলেটা জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, “লাগবে না। ডাক্তার লাগবে না। আসলে বেশি ব্যথা পাই নাই। খালি একটু রক্ত বের হয়েছে।”
“ঠিক তো?”
“জে। ঠিক। এক্কেবারে ঠিক।”
“বেশ। তা কী নাম বললে?” ছেলেটা মুখ থেকে রক্ত মুছতে মুছতে বলল, “ইয়ে–আমার নাম আজিজ।”
“আজিজ, এখন থেকে রাস্তাঘাটে খুব সাবধান। রিকশায় ধাক্কা খেয়েছ বলে বেঁচে গেছ। যদি একটা ট্রাক হত তা হলে আর দেখতে হত না। আর এই যে খুকি তোমাকে মানিব্যাগের জন্যে একটা রিসিট দিয়ে দিই।”
রিসিট নিয়ে শিউলি আবার ছেলেটাকে নিয়ে হাঁটতে থাকে। পুলিশ থেকে খানিকটা দূরে সরে দিয়ে ছেলেটা বলল, “এই মেয়ে–আমার এত কষ্টের রোজগার তুমি পুলিশকে দিয়ে দিলে?”
শিউলি মুখ ভেংচে বলল, “বেশি কথা বললে তোমাকেও পুলিশকে দিয়ে দেব, বুঝেছ?”
ছেলেটা পিচিক করে থুতু ফেলে বলল, “ইশ! কতগুলি টাকা!” তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ঠিক আছে, আমি গেলাম।”
“কই যাও আজিজ?”
“আমার নাম আজিজ না।”
শিউলি অবাক হয়ে বলল, “তা হলে পুলিশকে আজিজ বললে যে?”
“পুলিশকে আসল নাম বলে বিপদে পড়ব নাকি?”
“তা হলে তোমার আসল নাম কী?”
“বল্টু।”
“বল্টু! হি হি হি!” শিউলি হাসতে হাসতে বলল, “বল্টু কি কখনো কারও নাম হয়?”
“আমার বাবা গাড়ি মেকানিক ছিল তাই আমার নাম রেখেছিল বল্টু। আমার ছোট বোনের নাম রেখেছিল মোবিল।”
“তোমার বাবা এখন কী করে?”
“জানি না। বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেছে।”
“তোমার বোন?”
বল্টু একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “মরে গেছে। তখন একদিন মাও ঘর ছেড়ে চলে গেল।”
“তার মানে তুমি একা? তোমার কেউ নেই?”
বল্টু গম্ভীরমুখে বলল, “ওস্তাদজি আছে।”
“ওস্তাদজি? কিসের ওস্তাদজি?”
“পকেটমারা স্কুলের ওস্তাদজি।”
“তোমার পকেটমার ওস্তাদজি না থাকলেই ভালো ছিল।”
বল্টু কোনো কথা বলল না। হেঁটে হেঁটে দুজন একটা চৌরাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়াল। তখন বল্টু আবার বলল, “আমি গেলাম।”
“কোথায় যাবে?”
“দেখি কিছু রুজিরোজগার করা যায় কি না।”
শিউলি ভুরু কুঁচকে বলল, “রুজিরোজগার? কিসের রুজিরোজগার? আবার গিয়ে পকেট মারবে?”
“না হলে কী করব? না খেয়ে থাকব নাকি?”
শিউলি খপ করে বল্টুর ঘাড় ধরে বলল, “আর যদি কোনোদিন পকেট মার একেবারে ঘাড় ভেঙে ফেলব।”
“তা হলে খাব কী?”
“তোমার খাওয়া নিয়ে চিন্তা? আসো তোমাকে আমি খাওয়াব।”
কাজেই সেদিন বাসায় ফিরে রইসউদ্দিন আবিষ্কার করলেন বল্টু নামের নয় দশ বছরের শ্যামলামতন উদাস-উদাস চেহারার একটা ছেলে তার বাসায় উঠে এসেছে। শিউলি জানাল ছেলেটা নাকি রিকশার নিচে চাপা পড়ে ব্যথা পেয়েছে। কয়দিন এখানে থেকে একটু সুস্থ হয়েই চলে যাবে।
শিউলি বল্টুকে সাবান দিয়ে ডলে আচ্ছামতন গোসল করিয়ে আনল। বাসায় তার মাপমতো কোনো কাপড় ছিল না বলে মতলুব মিয়ার একটা লুঙ্গি আর রইসউদ্দিনের একটা পাঞ্জাবি পরিয়ে দেওয়া হল। পাঞ্জাবি পরার পর দেখা গেল সেটা তার পায়ের পাতা পর্যন্ত চলে এসেছে, নিচে লুঙ্গি না পরলেও ক্ষতি ছিল না। শিউলি বল্টুর নিজের ময়লা কাপড়জামা ধুয়ে বারান্দায় টানিয়ে দিল শুকানোর জন্যে।
রাত্রে খাবার টেবিলে রইসউদ্দিনের দুই পাশে খেতে বসেছে শিউলি আর বল্ট। মতলুব মিয়ার রান্না মুখে দিয়ে বল্টু হতাশভাবে মাথা নাড়ল রইসউদ্দিন জিজ্ঞেস করলেন, “কী হয়েছে?”