এই বলে মানুষটা আবার ছেলেটার মুখে আরেকটা ঘুসি মারল।
হাম এবং জলবসন্তের মতো মারপিট জিনিসটাও মনে হয় সংক্রামক। হঠাৎ করে ভিড়ের সবাই মিলে ছেলেটাকে ধরে মারতে লাগল, ইশ, সে কী ভয়ানক মার! দেখে মনে হল এক্ষুনি বুঝি ছেলেটাকে খুন করে ফেলবে। শিউলি আর সহ্য করতে পারল না, “থামান-থামান! বন্ধ করেন–কী করছেন–সর্বনাশ! মেরে ফেলবেন নাকি!” এইসব বলতে বলতে সে ভিড় ঠেলে প্রায় ছুটে গিয়ে ছেলেটাকে আড়াল করার চেষ্টা করল এবং ফুটফুটে স্কুলের একটা মেয়েকে এভাবে ছুটে আসতে দেখে সবাই এক সেকেন্ডের জন্যে মার বন্ধ করল।
শুকনোমতো যে-মানুষটা ছেলেটার চুল ধরে রেখেছিল সে তার মাথা ধরে একটা ঝাঁকুনি নিয়ে শিউলির দিকে তাকিয়ে বলল, “কী হয়েছে?”
“ছেলেটাকে মারছেন কেন?”
“মারব না তো কোলে নিয়ে চুমা খাব? শালার ব্যাটা পকেটমার”
ছেলেটা এই প্রথম কথা বলল, মুখ থেকে রক্তমাখা থুতু ফেলে বলল, “কে বলছে আমি পকেটমার?”
মানুষটা বলল, “আমি বলছি। আমার পকেট থেকে মানিব্যাগ সরিয়েছিস তুই।”
“আমি? কোথায় মানিব্যাগ?”
“শালার ব্যাটা, তুই পকেটে ঢুকিয়েছিস আমি স্পষ্ট দেখেছি।”
“দেখেছেন? ছেলেটা হাতের উলটো পিঠ দিয়ে নাকের রক্ত পরিষ্কার করতে করতে বলল, “মিছা কথা!”
মানুষটা দাঁত-কিড়কিড় করে বলল, “যদি বের করতে পারি, হারামজাদা?”
ছেলেটা পিচিক করে আবার রক্তমাথা থুতু ফেলে বলল, “আর যদি না পারেন?”
মানুষটা কোনো কথা না বলে নিচু হয়ে তার প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে খোঁজাখুঁজি করতে লাগল। ছেলেটার পকেটে কোনো মানিব্যাগ নেই, চারটা মার্বেল আর একটা ওষুধের হ্যাঁন্ডবিল পাওয়া গেল। মানুসটার চোয়াল ঝুলে পড়ে এবং হঠাৎ করে তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। ভাঙা গলায় বলল ”সর্বনাশ! মানিব্যাগ? আমার মানিব্যাগ!”
ছেলেটাকে ঘিরে যারা দাঁড়িয়েছিল তাদের একজন বলল, “পকেট মেরেছে পকেটমার আর খামোকা এই বাচ্চাটাকে মারলেন!”
মানুষটার তখন তার মানিব্যাগের শোকে পাগল হয়ে গেছে। ধাক্কা মেরে ছেলেটাকে প্রায় ফেলে দিয়ে এদিক-সেদিক তাকাতে থাকে। মনে হয় সে বুঝি মানুষের মুখের দিকে তাকিয়েই আসল পকেটমারকে ধরে ফেলবে।
মানুষটা চলে যেতে চাইছিল ছেলেটা লোকটার শার্টের কোণা ধরে ফেলল, মুখ শক্ত করে বলল, “আপনি আমাকে মিছামিছি মারলেন কেন?”
একটু আগেই যারা ছেলেটাকে ধরে দুই-এক ঘা লাগিয়েছে তাদেরই একজন মনে হল এখন ছেলেটার পক্ষ নিয়ে শুকনো মানুষটাকে দুই-এক ঘা লাগাতে চাইছিল, মানুষটা শার্টের হাতা গুটিয়ে বলল, “এই যে ভদ্রলোক, ছেলেটাকে যে মিছিমিছি মারলেন? এখন আপনাকে ধরে দেই কয়েকটা?”
শুকনো মানুষটা মুখ খিঁচিয়ে বলল, “আমি মিছামিছি মারি নাই। এই হারামির বাচ্চার সাথে তার দলবল আছে, তাদের হাতে আমার ব্যাগ সরিয়ে দিয়েছে।”
“কখন সরাল? আপনি না ধরে রাখলেন?”
“আপনার এত দরদ কেন? তাদের দলের একজন নাকি?”
“কী? আপনি কী বলতে চান? আমি পকেটমার? আপনার এত বড় সাহস।”
দেখতে দেখতে মানুষগুলো ঝগড়া লাগিয়ে দিল, এই ফাঁকে শিউলি ছেলেটার হাতে ধরে টেনে বের করে আনে। অল্প সময়ের মাঝে ছেলেটাকে ধরে শক্ত মার দেওয়া হয়েছে, ছেলেটার নাকমুখ দিয়ে এখনও রক্ত ঝরছে। হাঁটছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে।
ছেলেটা মাটিতে পিচিক করে থুতু ফেলে শিউলির দিকে তাকিয়ে বলল, “মানুষের মনে কোনো মায়া মহব্বত নাই।”
শিউলি চোখ পাকিয়ে বলল, “মানিব্যাগটা কী করেছ?”
ছেলেটা যেন খুব অবাক হয়ে গেছে সেরকম ভান করে বলল, “কোন মানিব্যাগ?”
“যেটা তুমি পকেট মেরেছ।”
“আমি? আমি পকেট মেরেছি?”
“হ্যাঁ।“
শিউলি চোখ ছোট ছোট করে বলল, “আমি তোমাকে বহুদিন থেকে লক্ষ করে আসছি। আমি সব জানি।”
ছেলেটার মুখে হঠাৎ ভয়ের একটা ছাপ পড়ল, কাঁপা গলায় বলল, “কী জান?”
“তোমার গলায় একটা তাবিজ থাকে। পকেটে মারার আগে তুমি সেটাকে চুমু খাও।”
ছেলেটার মুখ হঠাৎ হাঁ হয়ে গেল। শিউলি মুখ শক্ত করে বলল, “পকেট মেরে তুমি ম্যানিব্যাগ থেকে টাকা সরিয়ে খালি ব্যাগটা ঐ চিঠির বাক্সে ফেল।”
ছেলেটার চোখেমুখে এবারে একটা আতঙ্ক এসে ভর করল। হঠাৎ সে ছুটতে আরম্ভ করল কিন্তু ন্যাংচাতে ন্যাংচাতে খুব বেশিদূর যেতে পারল না। শিউলি পেছনে থেকে ছুটে এসে তাকে ধরে ফেলল। শার্টের কলার ধরে বলল, “তুমি ভয় পেয়ো না। আমি কাউকে বলব না।”
“খোদার কসম?”
“খোদার কসম।”
“শান্নি পীরের কসম?”
শান্নি পীর কী জিনিস শিউলি জানে না কিন্তু তবু বলল, “শান্নি পীরের কসম।”
ছেলেটা মনে হল একটু শান্ত হল, পুরোপুরি নিশ্চিত হল সেটা অবিশ্যি বলা যায় না, একটু ভয়ে ভয়ে শিউলির দিকে তাকিয় রইল। শিউলি বলল, “আমি জানি তুমি ঐ মানুষটার পকেট মেরেছ। এখন বলল দেখি ম্যানিব্যাগটা কোথায় সরিয়েছ?”
ছেলেটা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “তোমার ব্যাগে।”
“আমার ব্যাগে?” শিউলি হতভম্ব হয়ে বলল, “কী বললে? আমার ব্যাগে?”
“হ্যাঁ।”
শিউলি ছেলেটার কথা একেবারেই বিশ্বাস করল না, কিন্তু তবুও তার স্কুলব্যাগ খুলে ভেতরে উঁকি দিয়ে হঠাৎ করে তার শরীর জমে গেল। সত্যি সত্যি তার স্কুলব্যাগের ভেতরে একটা পেটমোেটা মানিব্যাগ।
শিউলি হতবাক হয়ে বলল, “আ-আ-আমার ব্যাগের ভেতরে এটা কেমন করে এল?”