পাজি আপা এরপর আর কোনোদিন শিউলির ক্লাসে পড়তে আসেননি।
০৪. শিউলির স্কুল বাসা থেকে
০৪.
শিউলির স্কুল বাসা থেকে খুব বেশি দূরে নয়। এটুকু পথ হেঁটে যেতে দশ মিনিটও লাগার কথা নয় কিন্তু শিউলির প্রতিদিনই প্রায় ঘণ্টাখানেক লেগে যায়। তার ঘুরে বেড়াতে ভালো লাগে তাই সোজাসুজি স্কুলে না গিয়ে প্রত্যেকদিনই একটু ঘুরপথে স্কুলে যায়। নতুন নতুন রাস্তা আবিষ্কার করে, নতুন নতুন জায়গা আবিষ্কার করে। সেই নতুন রাস্তায় নতুন জায়গায় কত বিচিত্র রকমের মানুষ, দেখতে শিউলির বড় ভালো লাগে। শিউলির সবচেয়ে ভালো লাগে বাসস্টেশনের মানুষজনকে দেখতে। ব্যস্ত হয়ে ছুটতে ছুটতে লোকজন আসে, কেউ তাড়াতাড়ি উঠে যায়, কেউ উঠতে পারে না, মাঝে মাঝে গ্রামের মানুষজন আসে, তারা কোনো তাল খুঁজে পায় না। বাসের হেল্পারদের দেখতেও খুব মজা লাগে, যখন মনে হয় কিছুতেই তারা বাসে উঠতে পারবে না, তখনও তারা কীভাবে কীভাবে জানি দৌড়ে বাসে গিয়ে ঝুলে পড়ে।
এই বাসস্টেশনে শিউলি একদিন পকেটমারকে আবিষ্কার করল। শিউলি বিকেলবেলা স্কুল থেকে বাসায় আসতে আসতে বাসস্টেশনের কাছে থেমেছে। একপাশে কিছু খালি পাকিংবাক্স রাখা আছে। তার একটার উপর পা ঝুলিয়ে বসে মানুষজনকে বাসে উঠতে দেখছে তখন হঠাৎ সে ঘটনাটা ঘটতে দেখল। পকেটমারটা ভান করল সেও বাসে উঠছে। ভিড়ের মাঝে ঠেলাঠেলি করার ভান করে সে হঠাৎ সামনে হাত বাড়িয়ে একজন মানুষ ছাড়িয়ে তার পরের জনের পকেট থেকে মানিব্যাগটা তুলে নিল। পুরো ঘটনাটা ঘটল একেবারে চোখের পলকে, ম্যাজিকের মতন। যে-মানুষের পকেট মারা হয়েছে সে কিছু টেরই পেল না, দাঁত বের করে হাসতে হাসতে আরেকজনের সাথে কথা বলতে বলতে বাসের ভেতরে ঢুকে গেল।
শিউলি চিৎকার করে পকেটমারটাকে ধরিয়ে দিতে পারত কিন্তু ধরিয়ে দিল না, তার কারণ পকেটমারটা আসলে বাচ্চা একটা ছেলে। দেখে মনে হয় তার থেকেও দুবছরের ছোট। এই টুকুন ছোট ছেলে হাত সাফাইয়ের এরকম চমৎকার কাজ শিখে গেছে দেখে শিউলি একেবারে মুগ্ধ হয়ে গেল। সে দেখল বাচ্চা পকেটমার বাস থেকে নেমে কিছুই হয়নি এরকম ভান করে হেঁটে যেতে শুরু করেছে। শিউলিও প্যাকিং বাক্স থেকে নেমে তার পিছুপিছু যেতে থাকল। ছেলেটা দুই পকেটে হাত ঢুকিয়ে উদাস-উদাস মুখে হেঁটে যেতে থাকে। শিউলি দেখতে পেল পকেটে তার হাত নড়ছে, নিশ্চয়ই মানিব্যাগের টাকা সরিয়ে নিচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ সে একটা চিঠি ফেলার বাক্সের সামনে দাঁড়িয়ে গেল। শিউলি দেখল পকেটখালি মানিব্যাগটা বের করে সে চিঠি ফেলা বাক্সের ভেতর ফেলে দিল, সে যে মানিব্যাগটা সরিয়েছে তার কোনো প্রমাণ রইল না। একেবারে নিখুঁত কাজ।
ছেলেটা কিছুই হয়নি এরকম ভান করে মাথা ঘুরিয়ে চারদিক দেখে হেঁটে হেঁটে একটা চায়ের দোকানে ঢুকে গেল। শিউলি বাইরে খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে শেষ পর্যন্ত বাসায় ফিরে এল।
এরপর থেকে শিউলি সময় পেলেই বাসস্টেশনে এসে সেই বাচ্চা পকেটমারকে খুঁজে বের করত। গায়ের রং শ্যামলা, মাথায় চুল ধূলিধূসরিত। নীল রঙের একটা প্যান্ট, সবুজ রঙের চেক চেক শার্ট, খালি পা। ছেলেটার চোখে উদাস উদাস একরকম ভাব। কেউ দেখলে তাকে কবি নাহয় শিল্পী বলে সন্দেহ করতে পারে, কিন্তু কিছুতেই পকেটমার বলে সন্দেহ করবে না। ছেলেটা ফুটপাতে বসে একটা ঘাস চিবুতে চিবুতে কিছুই দেখছে না এরকম ভান করে চোখের কোণা দিয়ে কার পকেট মারা যায় সেটা তীক্ষ্ণচোখে লক্ষ করত। যখন একটা ভালো শিকার পাওয়া যেত তখন সে উঠে দাঁড়াত। শিউলি দেখত গলায় ঝুলানো একটা তাবিজ বের করে সে চোখ বন্ধ করে একবার চুমো খেয়ে নিত। তারপর উদাস উদাস ভান করে হেঁটে যেত। সাপ যেভাবে ছোবল মারে ছেলেটা সেভাবে মানুষের পকেটে ছোবল মারত। শিউলি তীক্ষ্ণচোখে তাকিয়ে থেকেও বুঝতে পারত না কীভাবে চোখের পলকের মাঝে সে পকেটটা খালি করে ফেলছে–এককথায় অপূর্ব একটা কাজ!
সেদিন ঠিক এভাবে শিউলি বাসস্টেশনে বসে বসে পকেটমার বাচ্চাটাকে দেখছে। ফুটপাতে বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ সে উঠে দাঁড়াল। শিউলি দেখল গলা থেকে তাবিজটা বের করে একবার চুমো খেয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। শিউলি আন্দাজ করার চেষ্টা করল কোন মানুষটার পকেট মারবে, কিন্তু বুঝতে পারল না।
সামনে একটা ছোটখাটো ভিড়। ছেলেটা সেই ভিড়ে ঢুকে গেল। প্রতিবার সে পকেট মারতে যায় শিউলির তখন কেমন যেন ভয় ভয় করতে থাকে, যদি ধরা পড়ে যায় তখন কী হবে? শিউলি নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে আছে আর ঠিক তখন হঠাৎ ভিড়ের মাঝে একটা হৈচৈ শুনতে পেল, কে যেন চিৎকার করে বলল, “পকেটমার! পকেটমার!”
শিউলির হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল, সর্বনাশ! এখন কী হবে? উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে গিয়ে যা দেখল তাতে আর হৃৎপিণ্ড থেমে যাবার মতো অবস্থা হল। শুকনোমতন রাগী-রাগী, চেহারার একজন মানুষ বাচ্চা পকেটমারের চুলের মুঠি ধরে মুখের মাঝে প্রচণ্ড একটা ঘুসি মেরে বসেছে, দেখতে দেখতে তার নাক দিয়ে ঝরঝর করে রক্ত বের হয়ে এল। শুকনো মানুষটা ছেলেটার চুলের মুঠি ধরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “শুওরের বাচ্চা, হারামখোর, খুন করে ফেলব তোকে। জানে শেষ করে ফেলব।”