অঙ্ক ক্লাসে কেন লেফটেন্যান্ট বানান করতে হবে সেটা শিউলি বুঝতে পারল কিন্তু ক্লাসে সবার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হল এই ক্লাসে কেউ এই সমস্ত ছোটখাটো জিনিস নিয়ে মাথা ঘামায় না। অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে কিন্তু মেয়েটা সত্যি সত্যি লেফটেন্যান্ট বানান করে ফেলল।
পাজি আপা এতে আরও রেগে গেলেন। দাঁত-কিড়মিড় করে বললেন, “ডায়রিয়া?” মেয়েটা শুকনো মুখে বলল, “কার?”
“কারও না গাধা কোথাকার! বানান কর।”
“মেয়েটা ঢোক গিলে চেষ্টা করল, “ডি-আই-আই-আর—”
মহাপাজি আপা কানে ধরে ঘ্যাঁচ করে একটা হ্যাঁচকা টান দিয়ে মেয়েটাকে আরও দুইঞ্চি ওপরে তুলে ফেললেন। মেয়েটা যন্ত্রণার একটা শব্দ করে থেমে গেল, মনে হল বুঝতে পারল এই আপার সামনে কাতর শব্দ করে কোনো লাভ নেই। আপা বললেন, “পড়াশোনার নামে বাতাস নেই, দিনরাত শুধু নখড়ামো? ধ্যাষ্টামো? বাদরামো? একেবারে সিধে করে ছেড়ে দেব।”
শিউলি একটা নিঃশ্বাস ফেলল, কেউ যদি এখানে নখড়াননা ধ্যাষ্টামো বা বাঁদরামো করে থাকে সেটা হচ্ছে এই পাজি আপা। কাউকে যদি সিঁধে করার দরকার থাকে তা হলে এই মহাপাজি আপাকে।
পঞ্চম ছেলেটিকে কানে ধরে ঝুলিয়ে রেখে মনে হল পাজি আপা প্রথমবার শিউলিকে দেখতে পেলেন। খুব গরমের দিনে রোদের মাঝে হেঁটে এসে হঠাৎ করে ঠাণ্ডা পেপসির বোতল দেখলে মানুষের চোখে যেরকম একটা ভাব ফুটে ওঠে পাজি আপার চোখে ঠিক সেরকম ভাব ফুটে উঠল। আপা থপ থপ করে হেঁটে শিউলির সামনে হাজির হলেন, জিব দিয়ে সুড় করে লোল টেনে বললেন, “নতুন মেয়ে? আরেকটা বাঁদর? নাকি আরেকটা শিম্পাঞ্জি?”
পাজি আপা মাথা নিচু করে শিউলির চোখে চোখ রেখে তাকালেন। দূর থেকে ভাল করে দেখতে পায়নি কাছে আসার পর শিউলি দেখতে পেল আপার নাকের নিচে পাতলা গোঁফের রেখা। আপা নাক দিয়ে ফোৎ করে একটা শব্দ করলেন, “এই ক্লাসে সবাইকে আমি সিধে করে রাখি। মনে থাকবে?”
শিউলি মাথা নাড়ল, তার মনে থাকবে।
”আমাকে দেখেছ তো? দুষ্টু ছেলেপিলের আমি কল্লা ছিঁড়ে ফেলি। বুঝেছ?”
পাজি আপা শিউলির আরও কাছে এসে বললেন, “এইবার বলো দেখি চান, আমাকে দেখে তোমার কী মনে হয়?”
“সত্যি বলব?”
“বলো।”
“আজকে আপনি মোচ কামাতে ভুলে গেছেন।”
সারা ঘরে হঠাৎ একেবারে পিনপতন স্তব্ধতা নেমে এল। মনে হল একটা মাছি হাঁচি দিলেও বুঝি শোনা যাবে। পাজি আপা নিজের কানকে প্রথমে বিশ্বাস করতে পারলেন না, শিউলির দিকে মুখ হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন। তারপর মাথা ঘুরিয়ে ক্লাসের দিকে তাকালেন। ক্লাসের সবাই তখনও তার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। ঠিক তখন হঠাৎ কেউ-একজন একটা বিদঘুঁটে শব্দ করল, হাসি আটকে রাখার চেষ্টা করার পরও যখন হাসি বের হয়ে আসে তখন যেরকম শব্দ হয় শব্দটা অনেকটা সেরকম। হাসি সাংঘাতিক ছোঁয়াচে জিনিস, হাম বা জলবসন্ত থেকেও বেশি ছোঁয়াচে। তাই হঠাৎ একসাথে সারা ক্লাসের নানা কোণা থেকে বিদুঘটে শব্দ শোনা যেতে লাগল। এক সেকেন্ড পর দেখা গেল ক্লাসেই সবাই মুখে হাতচাপা দিয়ে হিহি করে হাসতে শুরু করেছে।
পাজি আপা চোখ পাকিয়ে ক্লাসের সবার দিকে তাকালেন, কয়েক পা এগিয়ে ক্লাসের মাঝামাঝি দাঁড়ালেন, এমনকি একটা ছোট হুংকার দিলেন। কিন্তু কোনো লাভ হল বলে মনে হল না, সবাই হাসতেই থাকল। তখন মাথা ঘুরিয়ে তাকালেন শিউলির দিকে। হুলো বিড়াল পাখির ছানার উপর লাফিয়ে পড়ার আগে চোখের দৃষ্টি যেরকম হয়, তার চোখের দৃষ্টি হল হুবহু সেরকম। নাক দিয়ে বিদঘুঁটে একটা শব্দ করে তখন চলন্ত ট্রেনের মতো ছুটে আসতে লাগলেন, শিউলি তখন বুঝতে পারল তার এখন বেঁচে থাকার একটিমাত্র উপায়।
মিতুর দেওয়া তেলের শিশিটা তখনও তার হাতে, ছিপিটা খুলে সাবধানে সে উপুড় করে তেলটুকু ঢেলে দিল সামনে। পাজি আপা এতকিছু খেয়াল করলেন না, হেঁটে একেবারে সেই তেলঢালা পিচ্ছিল জায়গায় এসে দাঁড়ালেন। গলা দিয়ে বাঘের মতো শব্দ করে শিউলির কান ধরার চেষ্টা করলেন। ধরেও ফেলেছিলেন প্রায়, কিন্তু কানে তেল মাখিয়ে রেখেছিল বলে শিউলি পিছলে মাথা বের করে নিল। পাজি আপা তাল সামলাতে পারলেন না, তার বিশাল দেহ নিয়ে মেঝেতে ঢেলে-রাখা তেলে আছাড় খেলেন।
ক্লাসের সব ছেলেমেয়ে সবিস্ময়ে দেখল তিনি পিছলে যাচ্ছেন, তাল সামলানোর চেষ্টা করছেন, একটা বেঞ্চ আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করলেন, ধরে রাখতে পারলেন না, মুখ দিয়ে বিকট গাগা শব্দ করতে করতে পাজি আপা উলটে পড়লেন। সমস্ত ক্লাসঘর তখন কেঁপে উঠল, মনে হল কাছাকাছি কোথাও যেন অ্যাটম বোমা পড়েছে!
ক্লাসে তখন একটা অত্যন্ত বিচিত্র ব্যাপার ঘটল, ছেলেমেয়েরা হঠাৎ করে আবিষ্কার করল, এই যে ভয়ংকর পাজি আপা তাকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। সেই আপাও একেবারে সাধারণ মানুষের মতো আছাড় খেয়ে পড়তে পারেন। শুধু তাই নয়, আছাড় খেয়ে পড়ে যাবার পর তাঁর বিশাল দেহ নিয়ে যখন উঠতে না পেরে হাঁসফাঁস করতে থাকেন তখন তাঁকে এতই হাস্যকর দেখাচ্ছিল যে কারওই বুঝতে বাকি থাকে না যে পাজি আপার ভয় দেখানোর পুরো ব্যাপারটাই আসলে একটা ভান।
ছেলেমেয়েদের ভয়ডর এত কমে গেল যে হেডমাস্টার যখন কী হয়েছে খোঁজ নিতে এলেন তখন তিনি আবিষ্কার করলেন, ছেলেমেয়েরা হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতে খেতে তাঁকে টেনেটুনে ঠেলেঠুলে তোলার চেষ্টা করছে–যেন পাজি আপা তাদেরই মতো একজন ক্লাসের ছেলে বা মেয়ে।