রাজি আপা হাততালি দিয়ে বললেন, “ভেরি গুড সুখময়, খুব সুন্দর কবিতা হয়েছে। এখন কে পড়ে শোনাবে?”
ক্লাসের মাঝামাঝি বসে-থাকা একটি মেয়ে কবিতার খাতা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। তার চুল পরিপাটি করে বাঁধা, ঠোঁটে লিপস্টিক, মুখে পাউডার। সে কাঁপা গলায় বলল,
“আমার নাম ফারজানা হক বন্যা
আমি একদিন হব মডেল কন্যা
আমি হব বিখ্যাত গান গায়িকা
আমি হবই হব প্যাকেজ নাটকের নায়িকা।”
রাজি আপা মুখ টিপে হেসে বললেন, “খুব সুন্দর কবিতা বন্যা। তুমি নিশ্চয়ই একদিন নায়িকা হবে। এরপর কে পড়তে চাও?”
পেছনের বেঞ্চ থেক কাসেম বলল, “আমারটা পড়ব আপা?”
“পড়ো দেখি।” কাসেম উঠে দাঁড়িয়ে মোটা গলায় বলল,
“কাসেম কাসেম
ঢেম ঢেম
ভুম ভাম ভেম
ঢেম ঢেম।”
রাজি আপা মাথা নেমে বললেন, “ভুম ভাম ঢেম এগুলা কিসের শব্দ কাসেম?”
“ককটেলের।”
“উঁইঁ। এরকম লিখলে হবে না। নিজের সম্পর্কে লিখতে হবে। আবার চেষ্টা করো।”
কাসেম মাথা নেড়ে আবার তার কাগজ নিয়ে বসে গেল। রাজি আপা শরিফার দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোমার কী খবর শরিফা?”
“প্রথম চার লাইন হয়ে গেছে আপা।”
“পড়ে শোনাও দেখি আমাদের!” ল্যাদল্যাদা শরিফা উঠে দাঁড়িয়ে গলা পরিষ্কার করে পড়তে শুরু করল :
“আমি শরিফা বেগম অতি বড় এক জ্ঞানপিপাসু মেয়ে।
প্রতিদিন আমি বই নিয়ে বসি রাতের খাওয়া খেয়ে।
অঙ্ক করি, বাংলা পড়ি, পড়ি বিজ্ঞান বই
হোমওয়ার্ক সব শেষ করে বলি আর হোমওয়ার্ক কই?”
রাজি আপা মুখ টিপে হেসে বললেন, “তোমার নিজেকে তুমি খুব সুন্দর ফুটিয়েছ শরিফা।”
শরিফা একগাল হেসে বলল, “এখনও তো শেষ হয়নি। শেষ হলে দেখবেন।”
রাজি আপা শিউলির দিকে তাকিয়ে বললেন, “এই যে আমাদের নতুন মেয়ে! তোমার কত দূর?”
শিউলি মাথা নাড়ল, “হয়ে গেছে।”
আপা বললেন, “পড়ো দেখি।”
শিউলি শুরু করল :
“শিউলি আমার নাম–
আমার সাথে তেড়িবেড়ি করলে ঘুসি মারি ধাম ধাম।
আমার সাথে ফাঁইট?
এমন শিক্ষা দেব আমি যে জন্মের মতো টাইট!”
শিউলির কবিতা শুনে রাজি আপার চোয়াল ঝুলে পড়ল, কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে শুকনো গলায় বললেন, “ইয়ে নিজেকে খুব সুন্দর করে প্রকাশ করেছ শিউলি। তবে কিনা–”
পেছনে থেকে কাউয়া কাসেম বলল, “ফাস্ট ক্লাস কবিতা হইছে আপা। একেবারে ফাস্ট ক্লাস! রবীন্দ্রনাথ ফেইল।”
সেকেন্ড পিরিওডে অঙ্ক ক্লাস। ঘণ্টা পড়ার পর শিউলি দেখল মোটামতন একজন কালো মহিলা মিলিটারির মতন দুমদাম করে পা পেলে ক্লাসে ঢুকলেন। মিতু তার ব্যাগের ভেতর থেকে একটা মাঝারি সাইজের শিশি বের করে শিউলিকে দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “নাও।”
“এটা কী?”
“তেল। কানে লাগিয়ে নাও।”
“কানে?”
“হ্যাঁ।”
“কেন?”
“টের পাবে একটু পরেই।”
শিউলি ঠিক বুঝতে পারল না কেন কানে তেল লাগাতে হবে। কিন্তু আর প্রশ্ন করল না। মিতুর দেখাদেখি দুই কানের লতিতে একটু তেল মেখে নিল। তেলের শিশিটা মিতুকে ফেরত দেওয়ার আগেই আপা ক্লাসে ঢুকে গেলেন, শিউলি তাড়াতাড়ি শিশিটা ডেস্কের নিচে লুকিয়ে ফেলল।
কালো মোটা এবং রাগী-রাগী চেহারার আপা ক্লাসে ঢুকেই টেবিলের উপর দুম করে তাঁর খাতাপত্র রেখে হুংকার দিলেন, “কে কে হোমওয়ার্ক আনে নাই?”
সারা ক্লাস চুপ করে রইল, হয় সবাই হোমওয়ার্ক করে এনেছে নাহয় যারা আনেনি তাদের সেটা স্বীকার করার সাহস নেই। শিউলি মাত্র আজকেই প্রথম ক্লাসে এসেছে, তার হোমওয়ার্ক আনার কথা কি না সেটাও সে ভালো করে জানে না। আপা চোখ পাকিয়ে সারা ক্লাসের দিকে তাকালেন। শিউলি দেখল তার চোখের সাদা অংশে লাল রঙের রগগুলো ফুলে রয়েছে। আপা দুই পা এগিয়ে এসে সামনে যাকে পেলেন খপ করে তার কান ধরে টেনে প্রায় শূন্যে তুলে ফেললেন। সেইভাবে ঝুলিয়ে রেখে বললেন, “দেখা হোমওয়ার্ক।”
একটা ছেলেকে কানে ধরে শূন্যে ঝুলিয়ে রাখলে তার পক্ষে হোমওয়ার্ক দেখানো খুব সহজ ব্যাপার নয়, কিন্তু সে তার মাঝেই হাতড়ে হাতড়ে তার বইখাতা ঘেঁটে তার অঙ্কখাতা বের করে এগিয়ে দিল। আপা সেইভাবে কান ধরে তাকে ঝুলিয়ে রেখে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে হুংকার দিলেন, “কোথায় হোমওয়ার্ক খুলে দেখা।”
ছেলেটা আধা-ঝুলন্ত অবস্থায় খাতা খুলে হোমওয়ার্কটি বের করে দিল, শিউলি ভাবল এবার নিশ্চয়ই তার কানটা ছেড়ে দেওয়া হবে কিন্তু আপা ছাড়লেন না। কানে ধরে ঝুলিয়ে রেখে খাতার পৃষ্ঠা উলটিয়ে কিছু-একটা দেখে বাজখাই গলায় ধমক দিলে বললেন, “পেন্সিল দিয়ে লিখেছিস কেন?”
ছেলেটা চিচি করে বলল, “তা হলে কী দিয়ে লিখব?”
“কলম দিয়ে, গাধা কোথাকার!”
শিউলি ভাবল এখন নিশ্চয়ই তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে, কিন্তু আপা তাকে ছাড়লেন না। সেভাবে ঝুলিয়ে রাখলেন। আরও খানিকক্ষণ খাতার দিকে তাকিয়ে থেকে হুংকার দিয়ে বললেন, “বলেছি না খাতার পাশে এক ইঞ্চি মার্জিন রাখতে? এত বেশি রেখেছিস কেন?”
এতক্ষণে শিউলি বুঝে গিয়েছে এই আপার নাম কেন পাজি আপা রাখা হয়েছে–মহাপাজি আপা রাখলেও খুব একটা ভুল হত না। শিউলির এবারে সন্দেহ হতে থাকে কান ধরে রাখা ছেলেটিকে আদৌ ছাড়া হবে কি না। যখন সে প্রায় নিঃসন্দেহে হয়ে গেল সে কানে ধরে ঝুলয়ে রেখে এই এক ঘণ্টাতেই ছেলেটার কানটি খানিকটা লম্বা করে দেওয়া হবে তখন তাকে ছেড়ে দিয়ে পাজি আপা দুপা এগিয়ে গিয়ে একটি মেয়ের কান ধরে তাকে শূন্যে তুলে ফেললেন। ছেলেটার দুর্গতি দেখে সে আগেই তার হোমওয়ার্কের খাতা খুলে রেডি হয়েছিল। মহাপাজি আপা তাই তাকে হোমওয়ার্কের কথা কিছু জিজ্ঞেস করলেন না, হুংকার দিয়ে জানতে চাইলেন, “লেফটেন্যান্ট বানান কর দেখি!”