কালোমতন মেয়েটা একটানা কথা বলে যেতে লাগল। শিউলি প্রায় মুগ্ধ বিস্ময় নিয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকে। কথা বলতে বলতে একসময় যখন নিঃশ্বাস নেবার জন্যে একটু থেমেছে তখন শিউলি জিজ্ঞেস করল, “তোমার নাম কী?”
“আমার আসল নাম ছিল মৃত্যু। আম্মু অবিশ্যি স্বীকার করে না। কিন্তু আমি শিওর। মৃত্যু থেকে মিততু। মিততু থেকে মিতু। এখন সবাই ডাকে মিতু। আমার অবিশ্যি মৃত্যু নামটাই ভালো লাগে। যখন বড় হব তখন আবার মৃত্যু করে ফেলব। কী সুইট না মৃত্যু নামটা? তোমার নাম কী? দাঁড়াও, আগেই বোলো না, দেখি আমি আন্দাজ করে বলতে পারি কি না। মানুষের চেহারার সাথে নামের মিল থাকে তো তাই চেষ্টা করলে পারা যায়। ভালো করে তাকাও আমার দিকে। তোমার নামটা একটু বেশি চোখা, পাখির ঠোঁটের মতো লাগে। তার মানে পাখি নামে নাম। ময়না না হলে তো তোতো না হলে টিয়া। ঠিক হয়েছে?
“উহ। আমার নাম শিউলি।”
“ইশ ভাই! একটুর জন্যে পারলাম না। তোমার কপালটা দেখে মনে হয়েছিল বলি ফুল, একেবারে ফুলের পাপড়ির মতো ছিল। ফুল হলেই বলতাম বকুল না হলে উঁই না হলে শিউলি। বলতাম না?”
শিউলি মাথা নাড়ল, হয়তো বলত। মিতু মেয়েটা আবার চলন্ত ট্রেনের মতো কথা বলতে শুরু করল, “তুমি প্রথম এসেছ তো তাই তোমাকে সবকিছু বলে দিতে হবে। না হলে তোমার বিপদ হতে পারে। আমাদের ক্লাসে কোনো নরমাল ছেলেমেয়ে নেই। সবগুলো অ্যাবনরমাল। অর্ধেকের বেশি হচ্ছে মেদামার্কা। সেগুলো নড়েচড়ে না, কথা বলে না। যেটা সবচেয়ে বেশি মেদামার্কা সেটার আবার চশমা আছে। সেটা পরীক্ষায় ফাস্ট হয়। সেটার নাম শরিফা, আমরা ডাকি ল্যাদাল্যাদা শরিফা। বাকি অর্ধেক হচ্ছে দুর্দান্ত। এর মাঝে কয়েকটা মনে হয় এর মাঝেই জেল খেটেছে। হরতালের সময় টোকাইরা গাড়ি ভাঙচুর করে জান তো–এরাও তখন তাদের সাথে গাড়ি ভাঙচুর করতে নেমে যায়। এদের লিডার হচ্ছে কাসেম। সবাই ডাকে কাউয়া কাসেম। কাউয়া কাসেম থেকে সাবধান। সবসময় তার পকেটে দুই-চারটা ককটেল থাকে। সেইদিন অঙ্ক পরীক্ষায় সরল অঙ্কের উত্তর হল সাড়ে তিন। সরল অঙ্কের উত্তর হবে এক নাহয় শূন্য–সাড়ে তিন কেমন করে হয়? কাউয়া কাসেম তখন রেগে গিয়ে বলল, চল গাড়ি ভাঙচুর করি। ঠিক তখন পাজি আপা এল ক্লাসে। কাঁক করে ঘাড়ে চেপে ধরে দুম করে মাথার মাঝে দিল একটা রদ্দা–কাউয়া কাসেম ঠাণ্ডা হয়ে গেল।”
শিউলি অবাক হয়ে মিতুর দিকে তাকিয়ে রইল তার মিতু একেবারে মেশিনের মতো মুখে খই ফোঁটাতে লাগল। একজন মানুষ যে এত কথা বলতে পারে সে নিজের চোখে না দেখলে ব্যাপারটা বিশ্বাস করত না। স্কুলের ঘণ্টা পড়ার আগেই এই স্কুল, স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী, মাস্টার-মাস্টারনি, দপ্তরি, বেয়ারা, বুয়া সবার সম্পর্কে শিউলির একেবারে সবকিছু জানা হয়ে গেল।
প্রথম ক্লাসটি বাংলা। পড়াতে এলেন ফরসামতন হালকা-পাতলা একজন কমবয়সী মহিলা। মিতু গলা নামিয়ে শিউলিকে বলল, “এইটা হচ্ছে রাজি আপা। রাজি আপাকে যেটা বলবে সেটাতেই রাজি।”
শিউলি দেখল কথাটি মিথ্যে নয়, রোল কল করার পরই মিতু হাত তুলে বলল, “আপা আজকে আমরা পড়ব না।”
“কেন পড়বে না মিতু?”
মিতু শিউলিকে দেখিয়ে বলল, “এই যে এই মেয়েটা আজকে আমাদের ক্লাসে নতুন এসেছে, সেইজন্যে আনন্দ করব।”
রাজি আপা হাসিহাসি মুখে বললেন, “কিন্তু তা হলে এই নতুন মেয়েটা যদি মনে করে এই স্কুলে মোটে পড়াশোনা হয় না?”
পেছনের বেঞ্চে বসা কুচকুচে কালো একটা ছেলে মোটা গলায় বলল, “তা হলে তো ভালোই হয়।”
মিতু ফিসফিস করে শিউলিকে বলল, “এইটা হচ্ছে কাউয়া কাসেম।”
একেবারে সামনে বসে থাকা চশমা পরা একটা মেয়ে একেবারে কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল, “না আপা না। পড়াশোনা না হলে কেমন করে হবে?”
মিতু ফিসফিস করে বলল, “ল্যাদল্যাদা শরিফা।”
রাজি আপা বললেন, “আচ্ছা তা হলে এক কাজ করা যাক। পড়াশোনাও হোক আবার আনন্দও হোক। সবাই একটা করে চার লাইনের কবিতা লেখো।”
ল্যাদল্যাদা শরিফা বলল, “কিসের উপর লিখব আপা? ছয় ঋতুর ওপরে? নাকি প্রকৃতির ওপরে?”
“সবাই নিজের ওপরে লেখো। তা হলে এই যে নতুন মেয়েটা সবার সম্পর্কে জানতে পারবে। ভালো হবে না?”,
ল্যাদল্যাদা শরিফা বলল, “খুব ভালো হবে আপা খুব ভালো হবে। কিন্তু আপা আমি নিজের সম্পর্কে মাত্র চার লাইনে কী লিখব? আমি কি বেশি লিখতে পারি? আট লাইন না হলে যোলো লাইন?
রাজি আপা বললেন, “ঠিক আছে লেখো।”
পেছন থেকে কাউয়া কাসেম বলল, “নিয়ম যখন ভাঙাই হল আমিও ভাঙি?”
রাজি আপা বললেন, “তুমিও বেশি লিখবে?”
“না আপা। আমি কম লিখব, এক লাইন লিখি?”
“এক লাইনে কবিতা হয় না কাসেম। কমপক্ষে চার লাইন লিখতে হবে। নাও সবাই শুরু করো।”
সবাই মাথা গুঁজে লিখতে শুরু করল। কোনো শব্দ নেই, শুধু কাগজের ওপর পেন্সিলের ঘসঘস শব্দ। মাঝে মাঝে শুধু কেউ-একজন আটকে-থাকা একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে দিয়ে আবার নতুন করে শুরু করছে।
কুড়ি মিনিট পর প্রথম কবিতাটি লেখা হল। লিখেছে মোটাসোটা গোলগাল একটি ছেলে, তার নাম সুখময়। রাজি আপা তাকে কবিতাটি পড়ে শোনাতে বললেন, সে লাজুক-মুখে পড়ে শোনাল :
“আমার নাম সুখময়
কিন্তু আমার জীবন বেশি সুখময় নয়,
কারণ–মাঝে মাঝে আমার
টনসিলে ব্যথা হয়।”