মানুষজনের হৈচৈ চিৎকার শুনে বাজারের লোকজন মনে করল বুঝি চাঁদাবাজরা এসেছে চাঁদা তুলতে। লাঠিসোটা নিয়ে কিছু মানুষ ছুটে এল তাড়া করে, কিছু বোঝার আগে দমাদম দুই-এক ঘা পড়ল মতলুব মিয়ার মাথায় আর ঘাড়ে।
সেদিন সন্ধ্যেবেলা মতলুব মিয়া যখন বাসায় ফিরে এল তাকে দেখে রইসউদ্দিন আঁতকে উঠলেন। তার জামাকাপড় ঘেঁড়া, কপালের কাছে ফুলে আছে, গালের কাছে খানিকটা ছাল উঠে গেছে এবং সে হাঁটছে ন্যাংচাতে ন্যাংচাতে। রইসউদ্দিন ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, “কী হয়েছে তোমার মতলুব মিয়া?”
“পাবলিক ধরে মার দিয়েছে।”
“কেন?”
“ভেবেছে আমি মাছ-বাজারে ককটেল ফাটিয়েছি।”
রইসউদ্দিন চোখ কপালে তুলে বললেন, “ককটেল? তুমি ককটেল ফাটিয়েছ?”
“না। আসলে ককটেল ফাটাই নাই। সিগারেটেটা যখন দুম করে বোমার মতো ফেটে গেল–”
“সিগারেট?”
“জে। মতলুব মিয়া মাথা চুলকে বলল, “কেন যে সিগারেটগুলো এইভাবে আগুন ধরে যাচ্ছে বুঝতে পারছি না!”
রইসউদ্দিনের কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল শিউলি, হঠাৎ সে মুখে হাত দিয়ে খিকখিক করে হেসে উঠল। হাসির শব্দ শুনে রইসউদ্দিন চমকে উঠে তার দিকে তাকালেন। হঠাৎ তার মাথায় একটা সন্দেহের কথা মনে হল। এগুলো কি শিউলির কাজ? যে-মেয়েটি কফিলউদ্দিন আর তাঁর স্ত্রীর মতো মহা ধুরন্ধর মানুষকে ঘোল খাইয়ে ছেড়ে দেয়, মতলুব মিয়ার মতো অকাট মূর্খ তো তার কাছে ছয় মাসের শিশু!
রইসউদ্দিন ঘুরে, শিউলির দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, “শিউলি!”
শিউলি মুখ তুলে তাকাল। বলল, “জি?”
“তুমি কি জান মতলুব মিয়ার সিগারেটে আগুন ধরে যাচ্ছে কেন?”
শিউলির মুখে দুষ্টুমির হাসি ফুটে ওঠে, সে মাথা নাড়িয়ে বলল, “জানি।”
মতলুব মিয়া হতভম্বের মতো শিউলির দিকে তাকিয়ে রইল। তোতলাতে তোতলাতে বলল, “জা-জা জান?”
“হ্যাঁ জানি। আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করলেই এরকম বিপদ হয়।”
“খা-খারাপ ব্যবহার করলে? কে-কে-কেন?”
শিউলি দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বলল, “আমার একটা পোষ জিন আছে তো তাই! হি হি হি!”
শিউলির হাসিমুখের দিকে তাকিয়ে রইসউদ্দিন হঠাৎ কেমন জানি দুর্বল অনুভব করতে থাকেন।
.
দুদিন পর মতলুব মিয়া এসে রইসউদ্দিনকে একটা ভালো বুদ্ধি দিল। বলা যেতে পারে মতলুব মিয়ার সুদীর্ঘ জীবনে এই প্রথমবার একটা কথা বলল যার ভেতরে খানিকটা চিন্তা-ভাবনার ব্যাপার আছে। সে রইসউদ্দিনকে বুদ্ধি দিল শিউলিকে স্কুলে ভর্তি করে দেওয়ার জন্যে। বুদ্ধিটি অবিশ্যি কোনো গভীর ভাবনা থেকে আসেনি, এটা এসেছে নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা থেকে। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে শিউলি মতলুব মিয়ার পেছনে লেগে যায়, ঘর পরিষ্কার করা, কাপড় ধোওয়া বাথরুম ধোওয়া, বাসন ধোওয়া, বাজার করা, রান্না করা–এমন কোনো কাজ নেই যেটা তার করতে হচ্ছে না। গত পঁচিশ বছরের একটানা আরাম মনে হচ্ছে রাতারাতি শেষ হতে চলেছ। শিউলিকে স্কুলে ভর্তি করে দিলে দিনের একটা বড় অংশ কাটবে স্কুলে। যতক্ষণ বাসায় থাকবে ততক্ষণ পড়োশোনাও করতে হবে–মতলুব মিয়ার পেছনে এত লাগার সুযোগ পাবে না।
শিউলিকে স্কুলে দেবার বুদ্ধিটি রইসউদ্দিনের পছন্দ হল। সত্যি কথা বলতে কি, কথাটি যে তার নিজের মনে হয়নি সেজন্য তার একটু লজ্জাও হল। শিউলির ছোট চাচাকে তিনি খোঁজা শুরু করেছেন। প্রথম ব্যাপারটিকে যত অসম্ভব মনে হয়েছিল এখন সেটাকে তত অসম্ভব মনে হচ্ছে না। তার নাম-ধাম জোগাড় হয়েছে। কয়েকদিনের মাঝেই আমেরিকার নানা জায়গায় চিঠিপত্র লেখা শুরু করবেন। কবে শিউলির ছোট চাচা খোঁজ পাবেন, কবে তাকে নিয়ে যাবেন তার নিশ্চয়তা নেই। পাঁচ-ছয় মাস এমনকি কে জানে বছরখানেক লেগে যেতে পারে। ততদিন তো শিউলিকে শুধুশুধু ঘরে বসিয়ে রাখা যায় না!
স্কুলে যাবার ব্যাপারটা শিউলির খুব পছন্দ হল না, কিন্তু রইসউদ্দিন সেটাকে মোটেই গুরুত্ব দিলেন না। তাকে নিয়ে রীতিমতো জোর করে পাড়ার একটা স্কুলে ভর্তি করে দিলেন। ভালো স্কুলে ছাত্র ভর্তি করা যেরকম খুব কঠিন, এই স্কুলটাতে মনে হল ভর্তি করানো ঠিক সেরকম সহজ। ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক বা ক্লাসঘর কোনোকিছুই ঠিকভাবে নেই। বেতন দিতে রাজি থাকলে মনে হয় তারা গরু ছাগল এমনকি চেয়ার-টেবিলও ভর্তি করে নিতে রাজি আছে!
স্কুলে গিয়ে প্রথম দিনে শিউলির কালোমতন একটা মেয়ের সাথে পরিচয় হল। স্কুলের গেটের কাছে দাঁড়িয়ে সে খুব শখ করে তেঁতুলের আচার খাচ্ছিল। শিউলিকে দেখে জিজ্ঞেস করল, “তুমি এই স্কুলে ভর্তি হয়েছ?”
“হ্যাঁ।”
“তোমার বাবা-মা নিশ্চয়ই ডিভোর্সি। বাবা-মা ডিভোর্সি হলে বাচ্চারা এই স্কুলে ভর্তি হয়। তখন তো বাচ্চার আর যত্ন থাকে না তাই সব বাবা-মা এনে এই স্কুলে ভর্তি করে দেয়। কঠিন স্কুল এটা। মাস্টার মাত্র দুইজন। মোটো মাস্টারনি আর চিকন মাস্টারনি। সাদা মাস্টারনি আর কালা মাস্টারনিও বলতে পার। রাগী মাস্টারনি আর হাসি মাস্টারনিও বলতে পার। যার যেটা ইচ্ছা সে সেইটা বলে আমি বলি রাজি আপা আর পাজি আপা। রাজি আপা সবকিছুতেই রাজি। তুমি যদি বল, আপা আজকে পড়তে ইচ্ছা করছে না তা হলে রাজি আপা সাথে সাথে রাজি হয়ে যাবে। বলবে ঠিক আছে। যদি পাজি আপাকে বল আপা পড়তে ইচ্ছা করছে না, পাজি আপা মনে হয় বন্দুক বের করে গুলি করবে ডিচুম ডিচুম। কেউ কখনো বলে নাই। পাজি আপার ক্লাসে কোনো হাসি-তামাশা নাই। নো নো নো…”