শিউলি মুখ শক্ত করে বলল, “তুমি খালি শুয়ে শুয়ে ঘুমাবে আর রইস চাচা কষ্ট করে করে তোমাকে খাওয়াবে সেটা হবে না।”
“দেখো ছেমড়ি–”
“খবরদার আমাকে ছেমড়ি বলবে না।”
“বললে কী হবে?”
“বলে দেখো কী হয়!”
“ছেমড়ি ছেমড়ি ছেমড়ি। বলেছি। কী হয়েছে?”
শিউলি কিছু না বলে উঠে গেল। মতলুব মিয়া দেখল তার কিছুই হল না, কিন্তু তবু কেমন যেন একটু ভয় পেয়ে গেল। এইটুকুন মেয়ে, কিন্তু চোখের দৃষ্টিটা কেমন যেন বাঘিনীর মতো।
মতলুব মিয়া আর কথাবার্তা না বলে বিছানা থেকে উঠে গেল। অবিশ্বাস্য মনে হলেও দেখা গেল সে সারাদিন ঘরদোর একটু পরিষ্কার করার চেষ্টা করেছে। দুপুরবেলা থালা-বাসন পর্যন্ত ধুয়ে ফেলল। সন্ধ্যে না হতেই রান্না শুরু করে দিল। তবে সে শিউলিকে চেনে না বলে বুঝতে পারল না, এত করেও তার বিপদ একটুও কাটা গেল না।
কাউকে শাস্তি দিতে হলে শিউলি প্রথমে তাকে গভীর মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করে, এবারেও সে তাই করল, গভীর মনোযোগ দিয়ে কয়েকদিন মতলুব মিয়ার কাজকর্ম লক্ষ করল। মতলুব মিয়ার কাজকর্ম লক্ষ করার একটামাত্র সমস্যা লক্ষ করার মতো কোনো কাজকর্মই সে করে না। বেশির ভাগ সময়েই সে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে নাহয় বসে থাকে। নেহাত দরকার না পড়লে সে নড়াচড়া করে না। পৃথিবীর সব মানুষের জীবনেই কোনো-না-কোনো উদ্দেশ্য বা শখ থাকে। তার জীবনে কোনো উদ্দেশ্য বা শখ কিছুই নেই। একমাত্র যে-জিনিসটাকে শখ বলে চালানো যায় সেটা হচ্ছে সিগারেট। সারাদিনে সে বেশ কয়েকটা সিগারেট খায়। রইসউদ্দিন সিগারেটের গন্ধ একেবারে সহ্য করতে পারেন না বলে সে সিগারেট খায় নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে। শিউলি চিন্তা-ভাবনা করে ঠিক করল এই সিগারেট দিয়ে মতলুব মিয়াকে কঠিন একটা শাস্তি দিতে হবে।
মতলুব মিয়া কী সিগারেট খায় জেনে নিয়ে একদিন শিউলি পাশের দোকান থেকে দুই শলা সিগারেট এবং একটা ম্যাচের বাক্স কিনে আনল। সিগারেটের ভেতর থেকে আধাআধি তামাক বের করে সে দেশলাইয়ের বারুদগুলো চেঁছে চেঁছে ভেতরে ঢোকাল। তারপর আবার সিগারেটের তামাকটা ঢুকিয়ে দিল। এমনিতে সিগারেটেটা দেখে কিছু বোঝার কোনো উপায় নেই কিন্তু আগুনটা যখন মাঝামাঝি পৌঁছে যাবে হঠাৎ করে দেশলাইয়ের বারুদ জ্বলে উঠবে। যে সিগারেট টানছে তার পিলে চমকানোর জন্যে এর থেকে ভালো বুদ্ধি আর কী হতে পারে?
দেশলাইয়ের বারুদভরা দুই শলা সিগারেট মতলুব মিয়ার বালিশের তলায়। রাখা সিগারেটের প্যাকেট ঢুকিয়ে দেওয়ার পরই শিউলির কাজ শেষ। এরপর শুধু অপেক্ষা করা।
শিউলি যেটুকু আশা করেছিল মতলুব মিয়ার সিগারেট নিয়ে তার থেকে অনেক বেশি মজা হল। রাত্রে ভাত খেয়ে তার বিছানায় বসে সে সিগারেট ধরিয়ে খুব আরামে কয়েকটা টান দিয়েছে হঠাৎ কথা নেই বার্তা নেই সিগারেটের মাঝে যেন একটা বোমা ফাটল! স্যাৎ করে বিশাল আগুন জ্বলে উঠল সিগারেটের মাথায়। কিছু বোঝার আগেই সেই আগুনে মতলুব মিয়ার গোঁফে আগুন ধরে গেল।
গোঁফে আগুন লাগলে সেটা নেভাবার কোনো উপায় নেই সেটা এই প্রথমবার মতলুব মিয়া আবিষ্কার করল। দেখতে দেখতে তার নাকের ডগায় সিকিভাগ গোঁফ পুড়ে ছাই হয়ে গেল। মতলুব মিয়া জ্বলন্ত সিগারেট ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বিকট গলায় চিৎকার করে উঠে বিছানা থেকে লাফ দিয়ে নিচে নামার চেষ্টা করল। কম্বলে জড়িয়ে গিয়ে পা বেঁধে হুমমুড় করে নিচে পড়ে যা একটা তুলকালাম কাণ্ড হল সে আর বলার মতো নয়। জ্বলন্ত সিগারেট গিয়ে পড়ল বিছানার চাঁদরে–সেখানে আবার একটা ছোটখাটো অগ্নিকাণ্ড ঘটে গেল।
মতলুব মিয়ার চিৎকার আর হৈচৈ শুনে রইসউদ্দিন এবং তাঁর পিছুপিছু শিউলি ছুটে এল। বিছানার চাঁদরে আগুন জ্বলছে, পানি ঢেলে সেই আগুন নিভিয়ে রইসউদ্দিন টেনেটুনে মতলুব মিয়াকে তুলে দাঁড় করালেন। নাকের ডগায় পুড়ে গোঁফের খানিকটা উধাও হয়ে গেছে বলে তাকে দেখতে এত বিচিত্র লাগছিল যে শিউলি মুখে হাত দিয়ে খিকখিক করে হেসে ফেলল। রইসউদ্দিন অবাক হয়ে বললেন, “কী হয়েছে মতলুব মিয়া?”
মতলুব মিয়া কাঁদোকাঁদো গলায় বলল, “সিগারেটটা হঠাৎ কেমন জানি দুম করে ফেটে গেল!”
রইসউদ্দিন ধমক দিয়ে বললেন, “সিগারেট কি গ্যাস বেলুন যে দুম করে ফেটে যাবে?”
“বিশ্বাস করেন–”মতলুব মিয়া ভাঙা গলায় বলল, “কথা নাই বার্তা নাই হঠাৎ করে দুম করে ফেটে আগুন ধরে গেল।”
রইসউদ্দিন আবার ধমক দিয়ে বললেন, “আজেবাজে কথা বলবে না মতলুব মিয়া। কতবার বলেছি ঘরের মাঝে বিড়ি-সিগারেট খাবে না–সেই কথা কি শুনে দেখেছ? সিগারেটের আগুনে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিচ্ছ, নিজের গোঁফ জ্বালিয়ে দিচ্ছ–ফাজলেমির তো একটা সীমা থাকা দরকার!”
.
মতলব মিয়ার দুই নম্বর সিগারেট নিয়ে আরও বেশি মজা হল। কারণ সেটাতে শব্দ করে হঠাৎ দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠল মাছ-বাজারে। চমকে উঠে ভয় পেয়ে বিকট চিৎকার করে মতলুব মিয়া সেই জ্বলন্ত সিগারেট ছুঁড়ে দিল সামনে, সেটি গিয়ে পড়ল এক মাছওয়ালার ঘাড়ে। সেই মাছওয়ালা জ্বলন্ত আগুন নিয়ে লাফিয়ে পড়ল পাশের মাছওয়ালার কোলে। মাছ-বাজারের কাদায় তারা গড়াগড়ি করতে লাগল আর তাদের ঝাপিতে রাখা আফ্রিকান রাক্ষুসে মাগুর মাছগুলো গড়িয়ে পড়ল নিচে। সেগুলো কিলবিল করে সাপের মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল, মাছ-বাজারের মানুষের পায়ে, আঙুলে কামড়ে ধরল একটি দুটি বদরাগী মাছ।