খেতে বসে প্লেটের দিকে তাকিয়ে শিউলি বলল, “এটা কী?”
মতলুব মিয়া ভান করল যেন সে প্রশ্নটা শুনতে পায়নি। শিউলি পেটের সাদামতন আঠা-আঠা জিনিসটায় হাত দিয়ে আরেকবার নেড়ে হাত গুটিয়ে নিয়ে বলল, “এটা কী না বললে আমি খাব না।”
২৭৫
মতলুব মিয়া মুখ শক্ত করে বলল, “ঢং কোরো না। এইটা ভাত।”
“ভাত?”
শিউলি পেটটা ধরের উলটো করে ফেলল, দেখা গেল সাদামতন আঠালো জিনিসটা পড়ল না, প্লেটে আটকে রইল। আঙুল দিয়ে সেটা দেখিয়ে বলল, “এইটা ভাত না। ভাত এভাবে আটকে থাকে না, নিচে পড়ে যায়।”
“ঠিক আছে ঠিক আছে বাবা–বুঝলাম। ভাতটা একটু গলে গেছে।”
“ভাত এভাবে গলে না। যদি এভাবে গলে সেটা ভাত থাকে না।”
টেবিলের অন্যপাশে বসে রইসউদ্দিন খুব মনোযোগ দিয়ে শিউলি এবং মতলুব মিয়ার কথাবার্তা শুনছিলেন। তাঁর প্লেটেও ভাত নামের এই সাদা আঠা আঠা জিনিসটা রয়েছে। তিনি জিনিসটা একটু নেড়েও দেখেছেন। মুখে দিতে ইচ্ছে করছে না, কিন্তু তাঁর কোনো উপায় আছে বলে মনে হচ্ছিল না। গত পঁচিশ বছর থেকে মতলুব মিয়া তাকে এরকম কুৎসিত জিনিস খাইয়ে আসছে। খাবার যে ভালোমন্দ হতে পারে, তার মাঝে যে উপভোগের একটা ব্যাপার আছে সেটা তিনি জানেনই না।
শিউলি সামনে বাটিতে রাখা খানিকটা মাছের ঝোলের দিকে দেখিয়ে বলল, “এটা কী?”
মতলুব মিয়া কঠিনমুখে বলল, “মাছের তরকারি।”
“মাছ রান্না করার আগে মাছকে কুটতে হয়, পেট থেকে নাড়িভুড়ি বের করতে হয়–এই দেখি এমনি বেঁধে ফেলেছ। ওয়াক, থুঃ!”
মতলুব মিয়া মুখ শক্ত কর বলল, ‘সেগুলি বড় মাছ। ছোট মাছ কুটতে হয় ণা।”
“তোমাকে বলেছে। এই দেখো মাছের পেটে নিশ্চয়ই কেঁচো আছে পিঁপড়ার ডিম আছে, ব্যাঙের পচা ঠ্যাং আছে–”এই বলে শিউলি সাবধানে একটা মাছের লেজ ধরে তুলে এনে পেটে চাপ দিতেই সত্যি সত্যি ময়লা হলদে এবং কালচে কিছু নোংরা জিনিস বের হয়ে এল। শিউলি নাক কুঁচকে খানিকক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “মতলুব চাচা, তুমি একটা আস্ত খবিশ!”
মতলুব মিয়া মুখ রাগে থমথম করতে থাকে। সে চোখমুখ লাল করে বলল, “এই মেয়ে, তুমি খাওয়া নিয়ে মশকরা কর? তুমি জান যারা না খেয়ে থাকে তারা এটা খেতে পেলে কী করবে?”
“কচু করবে!” শিউলি ঠোঁট উলটে বলল, “আমি অনেকদিন না খেয়ে থেকেছি। কফিল চাচার বাসায় কিছু হলেই আমাকে না খাইয়ে রাখত, কিন্তু আমি মরে গেলেও তোমার এই মাছ খাব না। হ্যাঁক, থুঃ!”
“তা হলে কী খাবে?”
“তুমি আবার সবকিছু ঠিক করে রান্না করবে।”
“ইশ! মামাবাড়ির আবদার!” মতলুব মিয়া মুখ ভেংচে বলল, “এখন আমি লাটসাহেবের জন্যে সবকিছু আবার নতুন করে রান্না করব! আমার তো আর খেয়েদেয়ে কাজ নাই!”
শিউলি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “ঠিক আছে, তা হলে আমিই রান্না করব।”
রইসউদ্দিন অবাক হয়ে বললেন, “তুমি রান্না করতে পার?”
শিউলি মাথা নেড়ে বলল, “না।”
“তা হলে?”
“মতলুব চাচাও তো পারে না। সে রান্না করছে না?”
অকাট্য যুক্তি। রইসউদ্দিন কিছু বলতে পারলেন না, তবে মতলুব মিয়া মেঘের মতো গর্জন করে বলল, “কী বললে?”
“তুমি শুধু যে রাঁধতে পার না তা-ই না। তুমি জান পর্যন্ত না কী দিয়ে রাঁধতে হয়।”
“আমি কী দিয়ে রাধি?”
“কেরোসিন তেল দিয়ে। তোমার সব খাবারে খালি কেরোসিনের গন্ধ। হ্যাঁক, থুঃ!”
মতলব মিয়া দাঁত-কিড়মিড় করতে লাগল। তাকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে শিউলি বলল, “আর এই প্লেটগুলো দেখো।”
“কী হয়েছে প্লেটে?”
“উপর দিয়ে চিকা হেঁটে গেছে, তুমি সেই প্লেট ধোও নাই। এই দেখো, চিৎকার পায়র ছাপ দেখা যাচ্ছে।”
রইসউদ্দিন ভালো করে শিউলির প্লেটটা দেখলেন, সত্যি সত্যি প্লেটের পাশে ময়লা, ছোট ছোট পায়ের ছাপ। শিউলি রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে বলল, “রইস চাচা, তুমি অপেক্ষা করো, আমি বেঁধে আনছি। শুধু চুলোটা কেমন করে ধরাতে হয় একটু দেখিয়ে দেবে?”
মতলুব মিয়া সারাক্ষণ মুখ গোঁজ করে রইল। তার মাঝে সত্যি সত্যি শিউলি খানিকটা ভাত বেঁধে ফেলল, সাথে ডিমভাজা। রইসউদ্দিন অনেক দিন পর বেশ তৃপ্তি করে ভাত খেলেন।
পরদিন রইসউদ্দিন অফিসে গেছেন। টেবিলে টোস্ট বিস্কুট রাখা থাকে, তাই দিয়ে তিনি নিজে সকালের নাশতা সেরে ফেলেন। মতলুব মিয়া কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে থাকে তার ঘুম থেকে উঠতে বেশ দেরি হয়। আজ অবিশ্যি দেরি করতে পারল না, শিউলি তাকে ডেকে তুলে ফেলল।
মতলুব মিয়া চোখ লাল করে বলল, “কী হয়েছে?”
“ওঠো। অনেক বেলা হয়ে গেছে।”
“উঠে কী হবে?”
“ঘরদোর পরিষ্কার করতে হবে। দেখেছ ঘরবাড়ির অবস্থা?”
মতলুব মিয়া কম্বল সরিয়ে উঠে বসল। তাকে দেখে মনে হতে লাগল সে বুঝি কারও উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। চোখ-মুখ পাকিয়ে বলল, “ছেমড়ি–”
শিউলি বাধা দিয়ে বলল, “খবরদার, আমাকে ছেমড়ি বলবে না!”
মতলুব মিয়া গর্জন করে বলল, “ছেমড়িকে ছেমড়ি বলব না তো কী বলব? শুনো ছেমড়ি, আমি এই বাসাতে আছি আজ পঁচিশ বছর–তুমি আসছ পঁচিশ ঘণ্টাও হয় নাই। এই বাসায় কী করতে হবে কী না-করতে হবে সেই হুকুম তুমি দেবে না।”
“আমি মোটেও হুকুম দিচ্ছি না। কিন্তু ঘরদোর ময়লা হয়ে আছে সেটা পরিষ্কার করতে হবে না?”
“আমার যখন ইচ্ছা হবে আমি পরিষ্কার করব। তোমাকে বলতে হবে না।”
“একশো বার বলতে হবে।”