ডাক্তার মাথা নিচু করে বলল, “আমি খুব দুঃখিত মিস্টার ইশতিয়াক। পৃথিবীর নিষ্ঠুরতার অর্থ কেউ জানে না। কেউ জানে না।”
“এর কোন চিকিৎসা নেই?”
“প্রচলিত মেডিক্যাল সায়েন্সে এর কোন চিকিৎসা নেই।”
“কেউ বাঁচে না এই রোগ হলে?” ডাক্তার কোন কথা না বলে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল। ইশতিয়াক সাহেব প্রায় আর্তনাদ করে উঠে জিজ্ঞেস করলেন, “কেউ বাঁচে?”
“মেডিক্যাল জার্নালে এক-দুইটি কেস পাওয়া গেছে যখন রোগীর ইমিউন সিস্টেম নিজে নিজে রিকভার করেছে। কিন্তু সেগুলি নেহাতই কাকতালীয় ব্যাপার। মেডিক্যাল জার্নালে তো র্যাবিজ থেকে আরোগ্য হয়েছে এরকম একটা কেসও ডকুমেন্টেড আছে।”
“আমাদের কিছুই করার নেই? কিছুই করার নেই?”
ডাক্তার কোনো উত্তর না দিয়ে হঠাৎ খুব মনোযোগ দিয়ে হাতের নখগুলো দেখতে শুরু করল।
“কিছুই কি আমাদের করার নেই? কিছুই?”
ডাক্তার পূর্ণদৃষ্টিতে ইশতিয়াক সাহেবের দিকে তাকিয়ে থেকে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “আপনি যদি ঈশ্বরকে বিশ্বাস করেন তা হলে তার কাছে প্রার্থনা করতে পারেন। আর কিছুই যদি না হয় অন্ততপক্ষে আপনি হয়তো এটা গ্রহণ করার শক্তি পাবেন।”
ইশতিয়াক সাহেব আর কিছু না বলে ডাক্তারের কাছে থেকে উঠে এসেছিলেন। তারপর আরও এক বছর কেটে গেছে। খুব ধীরে ধীরে নীলার শরীর আরও দুর্বল হয়েছে। তার ফ্যাকাশে রক্তশূন্য মুখ, বড় বড় কালো চোখ, রেশমের মতো কালো চুল দেখলে তাকে মোমের পুতুলের মতো মনে হয়। নীলা এমনিতে শান্ত মেয়ে, মা মারা যাবার পর আরও শান্ত হয়ে গিয়েছিল–ইদানীং একেবারে চুপচাপ হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে জ্বরে থাকে। যে-পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবে সেই পৃথিবীর জন্যে হঠাৎ হঠাৎ তার বুকের ভিতরে এক বিচিত্র ধরনের মমতার জন্ম হয়।
.
ইশতিয়াক সাহেব নীলাকে নিয়ে তার বাসায় ফিরে এলেন সন্ধ্যে সাতটায়। নীলাকে নিয়ে তার বিছানায় শুইয়ে দিয়ে সাথে সাথে ডাক্তার আজমলকে ফোন করলেন। আজমল শুধু পারিবারিক ডাক্তার নন, ইশতিয়াক সাহেবের ছেলেবেলার বন্ধু, একে অন্যের সাথে তুই-তুই করে কথা বলেন।
আজমল তার ক্লিনিকে খুব ব্যস্ত ছিলেন বলে আসতে আসতে রাত দশটা বেজে গেল। নীলা তখন তার বিছানায় শান্ত হয়ে ঘুমুচ্ছে, ইশতিয়াক সাহেব বারান্দায় অন্ধকারে চুপচাপ বসে আছেন। ডক্টর আজমলকে দেখে ইশতিয়াক সাহেব উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “ছাড়া পেলি শেষ পর্যন্ত?”
“পাইনি কিন্তু চলে এসেছি। আজকাল চিকিৎসাটা প্রয়োজন নয়, ফ্যাশান। নীলার কী খবর?”
ইশতিয়াক সাহেব একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “নতুন কিছু নয়, ঐরকমই আছে। লঞ্চে হঠাৎ শরীর খারাপ করল, ভাবলাম তোকে দেখাই।”
“এখন কী ঘুমুচ্ছে?”
“হ্যাঁ।”
“তা হলে আর তুলে কাজ নেই। আমি এমনি দেখে যাই, ভোরবেলা এসে ভালো করে দেখব। আরেকটা থরো চেকআপের সময় হয়ে গেছে।”
ইশতিয়াক সাহেব একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বললেন, “আর চেকআপ! মেয়েটাকে শুধু শুধু কষ্ট দেওয়া।” ইশতিয়াক সাহেব হঠাৎ করে সুর পালটে বললেন, “আচ্ছা আজমল, তুই বল দেখি আমি কি অন্যায় করেছি যে খোদা আমাকে এমন একটা শাস্তি দিলেন? কী করেছি?”
ডক্টর আজমল এগিয়ে এসে ইশতিয়াক সাহেবের কাঁধ স্পর্শ করে বললেন, “খোদা কাউকে শাস্তি দেয় না রে ইশতিয়াক! জীবনটাই এরকম।”
“কী করি আমি বল দেখি?”
“তুই এখন ভেঙে পড়িস না ইশতিয়াক। নীলার কথা ভেবে তুই এখন শক্ত
“কী করব আমি?”
ডক্টর আজমল দীর্ঘ সময় চুপ করে থেকে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “মানুষের ক্লিনিক্যাল একটা ব্যাপার থাকে, আবার সাইকোলজিক্যাল একটা ব্যাপার থাকে। নীলার সমস্যাটা কী জানিস? মেডিক্যাল সমস্যাটা দেখা দেবার অনেক আগেই সে বেঁচে থাকার ইচ্ছা হারিয়ে ফেলেছে।”
ইশতিয়াক সাহেব মাথা নাড়লেন, নিচু গলায় বললেন, “একটা মানুষ যে তার মাকে কত ভালবাসতে পারে সেটা নীলাকে আর শাহনাজকে দিয়ে বুঝেছিলাম। বুঝলি আজমল, দুজনকে দেখে মনে হত একজন মানুষ!”
ডক্টর আজমল মাথা নাড়লেন, বললেন, “আমি জানি।”
“মা মারা যাবার শক থেকে আর কখনো রিকভার করেনি।”
“হ্যাঁ। যদি কোনভাবে নীলাকে আবার বেঁচে থাকার জন্যে একটা স্টিমুলেশান দেওয়া যেত!”
ইশতিয়াক সাহেব একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “তুই তো জানিস–আমি সব চেষ্টা করেছি। সব। পৃথিবীর কোন কিছু ছেড়ে দিইনি। নীলা কিছু চায় না। একেবারে কিছু না।”
দুইজন দীর্ঘ সময় অন্ধকারে চুপ করে বসে রইলেন। একসময় ইশতিয়াক সাহেব উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “চল যাই নীলার ঘরে। তোর নিশ্চয়ই দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
ড. আজমল নীলাকে না জাগিয়েই তাকে দেখলেন। ঘুমের মাঝে নীলা ছটফট করে কী-একটা বলল। ডক্টর আজমল মাথা ঝুঁকিয়ে শুনতে চেষ্টা করলেন, ঠিক বুঝতে পারলেন না, মনে হল সে একজনকে বলছে তাকে নিয়ে পানিতে ঝাঁপ দিতে। কিছু-একটা নিয়ে স্বপ্ন দেখছে নীলা, এতকিছু থাকতে পানিতে ঝাঁপ দেওয়া নিয়ে স্বপ্ন কেন দেখছে ডক্টর আজমল ঠিক বুঝতে পারলেন না।
০৩. বকুনি খেয়ে বকুলের মন-খারাপ
বকুনি খেয়ে আজকে বকুলের খুব মন-খারাপ হল। বকুনিটা প্রথমে শুরু করলেন বাবা, সেটাকে বড়চাচা লুফে নিলেন, বকতে বকতে যখন বড়চাচার দম ফুরিয়ে গেল তখন মা শুরু করলেন। বকুনি খেতে খেতে বকুলের এমন অবস্থা হয়েছে যে আজকাল সে ভালো করে খেয়ালও করে না কেন সে বকুনি খাচ্ছে। তাকে উদ্দেশ্য করে যে-কথাগুলো বলা হয় তার প্রত্যেকটা শুরু হয় এভাবে—’একটা মেয়ে হয়ে তুই—’ ভাবখানা মেয়ে হওয়াটাই অপরাধ, ছেলে হলেই তার সাত খুন মাপ করে দেওয়া হত। বকুনির শেষ পর্যায়ে যখন সবাই মিলে বলতে লাগল তাকে স্কুল ছাড়িয়ে নিয়ে এসে ঘর-সংসারের কাজে লাগানো হবে তখন তার প্রথমে রাগ এবং শেষের দিকে খুব মন-খারাপ হয়ে গেল। সেইসময় বকুল তার মন-খারাপ লুকিয়ে রেখে শুধু রাগটা দেখিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে এসেছে।