১৯৮
তাকিয়ে থাকে। যে মানুষের চেহারা এত সুন্দর, যে এরকম রাজহাঁসের মতো লঞ্চে করে স্বপ্নের জগতের মানুষদের সাথে নিঃশব্দে পানি কেটে কেটে যায় তার মনে না জানি কী বিচিত্র ধরনের সুখ। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বকুল কেমন জানি একধরনের হিংসা অনুভব করে। আহা, সেও যদি এরকম সুন্দর কাপড় পরে এরকম সেজেগুঁজে এই রাজহাঁসের মতো লঞ্চে করে যেতে পারত।
লঞ্চটা আরও এগিয়ে আসতে থাকে, বকুল ভালো করে দেখার জন্যে ডাল বেয়ে বেয়ে নদীর পানির দিকে এগিয়ে যায়। সেখানে দুটি সরু সরু ডাল বের হয়ে এসেছে, ডাল দুটিতে পা রেখে সাবধানে দাঁড়িয়ে থাকা যায়। বকুল দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পায় চাপা একটা শব্দ করতে করতে লঞ্চ এগিয়ে আসছে, উপরে একটা চেয়ারে বয়স্ক একজন মানুষ বসে আছে, তার পাশে আরেকটা চেয়ার রেলিঙে হাতের উপর মুখ রেখে সেই মেয়েটি বসে আছে। মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থেকে বকুল প্রায় একটা চাপা শব্দ করে ফেলল, ইশ কী সুন্দর মেয়েটি। আর হঠাৎ কী আশ্চর্য, মেয়েটি মুখ ঘুরিয়ে সোজাসুজি বকুলের দিকে তাকাল। বকুলকে দেখে কেমন যেন চমকে উঠল মেয়েটি, বকুল দেখতে পেল সোজা হয়ে বসেছে হঠাৎ, মুখটিতে কেমন যেন একটা বিস্ময়ের ছাপ পড়েছে, অবাক হয়ে দেখছে সে বকুলকে। লঞ্চটা প্রায় নিঃশব্দে এগিয়ে আসছে, একজনের কাছে আরেকজন আরও স্পষ্ট হয়ে আসছে ধীরে ধীরে। বকুল দেখতে পাচ্ছে মেয়েটার চুল বাতাসে উড়ছে, তার মুখে অস্পষ্ট সুক্ষ্ম একধরনের হাসি, চোখে আশ্চর্য একধরনের বিস্ময়–
“কী হচ্ছে এখানে?”
হঠাৎ গাছের নিচে থেকে বাজখাই একটা ধমক শুনতে পেল বকুল। তার বড়চাচার গলার স্বর, গাছের নিচে বাচ্চাকাচ্চাদের ভিড় দেখে এগিয়ে এসেছেন। হিজল গাছটা নিয়ে কিছু-একটা ঝামেলা হয়েছে বুঝতে পেরেছেন নিশ্চয়ই। মুখ ঘুরিয়ে তাকাবেন এক্ষুনি, বকুলকে দেখতে পাবেন সাথে সাথে, মহা একটা কেলেঙ্কারি হবে তখন। বকুল নিঃশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকে, নিজেকে আড়াল করে ফেলতে চায় গাছের পাতার আড়ালে। “কী হল, কথা বলে না কেন কেউ?”
বড়চাচার প্রচণ্ড ধমক খেয়ে সিরাজ আমতা আমতা করে বলল, “না, মানে ইয়ে–”
বকুল বুঝতে পারল আর এখানে থাকা যাবে না, পালাতে হবে। বাচ্চাকাচ্চা যারা আছে তারা নিজে থেকে কখনো বকুলের কথা বলে দেবে না, কিন্তু ধমক খেলে অন্য কথা। বড়চাচার ধমক বিখ্যাত ধমক, বয়স্ক মানুষেরা পর্যন্ত কেঁদে ফেলে। বকুল নিচে তাকাল, নদীর কালো পানি ঘুরপাক খাচ্ছে, ছোট একটা ঘূর্ণির মতো হয়েছে সেখানে। গাছটা অনেকখানি উঁচু, পানি আরও নিচে, এত উঁচু থেকে আগে কখনো পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়েনি, কিন্তু তাতে কী হয়েছে? বকুল নিঃশব্দে হাত উঁচু করে ডাইভ দেওয়ার প্রস্তুতি নেয়, নদীর পানি ছলাৎ ছলাৎ করে তীরে আঘাত করছে, সেই শব্দের আড়ালে যথাসম্ভব নিঃশব্দে ডাইভ দিতে হবে, ব্যাপারটি এমন কিছু কঠিন নয় তার জন্যে। বকুল গাছের ডালে নিঃশব্দে দোল খেয়ে নিচের পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল, ছিপছিপে শরীরে তীরের মতো নিচে ঝাঁপিয়ে পড়তে পড়তে সে শেষবারের মতো লঞ্চে বসে-থাকা মেয়েটির দিকে তাকাল। মেয়েটির চোখে আতঙ্ক এবং অবিশ্বাস, আর্তচিৎকার করে রেলিং ধরে উঠে দাঁড়িয়েছে সে।
পানির নিচে ঝপাং করে অদৃশ্য হয়ে গেল বকুল। দুই হাত দিয়ে পানি কেটে কেটে এগিয়ে যেতে থাকে সে, স্রোতে গা ভাসিয়ে চলে যেতে হবে যতদূর সম্ভব, তারপর ভেসে উঠবে। বড়চাচা কোনদিনও জানতেও পারবেন না কে ছিল হিজলগাছে।
কালো পানিতে সাঁতার কেটে কেটে এগিয়ে যেতে থাকে বকুল, তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে পরীর মতো মেয়েটার চেহারা, কী বিচিত্র অবিশ্বাস আর আতঙ্ক ছিল মেয়েটার চোখে! কী ভাবছিল মেয়েটি? তার লাল রুক্ষ চুল, রং-জ্বলা ফ্রক, শ্যামলা রং, শুকনো হাত-পা দেখে মেয়েটার কি হাসি পাচ্ছিল? সে কি হাসছিল মনে-মনে? যারা স্বপ্নের জগতে থাকে তারা কি কখনো ভাবে বকুলের মতো এরকম মেয়েদের কথা? কোন কি কৌতূহল হয় তাদের?
০২. নীলা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে
নীলা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে চিৎকার করে বলল, “দেখেছ বাবা?”
ইশতিয়াক সাহেব পাশে বসে ছিলেন, তিনিও উঠে দাঁড়ালেন, অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন, “কী মা?”
“একটা–একটা মেয়ে–”
“কী হয়েছে মেয়েটার?”
“পানিতে ডাইভ দিল। কী সুন্দর মেয়েটা বাবা, যেন কেউ গ্রানাইট কেটে তৈরি করেছে। গাছের উপর দাঁড়িয়েছিল।”
“কোথায়? কোন্ গাছে?”
“ঐ যে বাবা ঐ বড় গাছটায় ছিল। এক্ষুনি পানিতে ডাইভ দিল।”
“সত্যি?”
“সত্যি!”
নীলার দুর্বল শরীর উত্তেজনা বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারল না, রেলিং ধরে আবার বসে পড়ে বলল, “কী সুন্দর ডাইভ দিয়েছে তুমি বিশ্বাস করবে না বাবা। ঠিক যেন অলিম্পিকের ডাইভ। একেবারে ডলফিনের মতো”
“তাই নাকি?”
“হ্যাঁ বাবা, এখনও ডুবে আছে মেয়েটা, ভেসে উঠছে না কেন? কিছু হয়নি তো মেয়েটার?”
“কী হবে, গ্রামের মেয়ে তো–এরা একেবারে মাছের মতো সাঁতার কাটে।”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ, মা, সত্যি।”
নীলা একদৃষ্টে নদীর তীরের বিশাল হিজল গাছটার দিকে তাকিয়ে রইল। তাদের লঞ্চটি পানিতে ঢেউ তুলে নিচু শব্দ করতে করতে সরে যাচ্ছে। সেখানে পাথর কুঁদে তৈরি করা অপূর্ব মেয়েটি বিশাল একটা গাছ থেকে ডলফিনের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছে গভীর কালো পানিতে। কী সাহস মেয়েটির! চোখে-চোখে তাকিয়েছিল সে মেয়েটির দিকে, চোখের মাঝে কী জ্বলজ্বলে একধরনের ভাব, দেখে মনে হয় যেন একটা চিতাবাঘ! সমস্ত শরীরটা যেন ইস্পাতের তৈরি ধনুকের ছিলা, টানটান হয়ে আছে! কী সুন্দর! কী চমৎকার! আহা, সেও যদি হত ঐ মেয়েটার মতো–পাথরে কুঁদে তৈরি করা একটা শরীর হত তার? ধনুকের ছিলার মতো টানটান হয়ে থাকত তার শক্ত একটা শরীর, আর একেবারে আকাশের কাছাকাছি থেকে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারত নদীর কালো পানিতে! মাছের মতো সাঁতার কাটত ঐ সুন্দর মেয়েটার মত।