বকুল যে-ঘটনাটা মনে করে হাসতে শুরু করেছে সেই ঘটনার নায়ক সিরাজ নিজে। সে যখন ছোট হঠাৎ একদিন জমিলা বুড়িকে দেখে ভয় পেয়ে পরনের কাপড় ছোট দুর্ঘটনা ঘটিয়ে দিয়েছিল, এতদিন পরেও কারণে-অকারণে সেটা মনে করিয়ে তাকে নানাভাবে অপদস্থ করা হয়। কাজেই সিরাজ বকুলর কথাটা খুব সহজভাবে নিল না। চোখমুখ লাল করে বলল, “তার মানে তুই বলতে চাস তুই জমিলা বুড়িকে ভয় পাস না?”
বকুল পেয়ারার শেষ অংশ মুখে পুরে কচকচ করে চিবুতে চিবুতে বলল, “একটা বুড়িকে আবার ভয় পাবার কী আছে?”
“তার মানে তার মানে–সিরাজ রাগের চোটে তার কথা শেষ করতে পারে না। বকুল গাছের সরু ডালে একটা দোল খেয়ে নিচে নামতে নামতে বলল, “তার মানে কী?”
“তার মানে তুই জমিলা বুড়ির কথা বিশ্বাস করিস না?”
“পাগল মানুষের কথা বিশ্বাস করলেই কি আর না-করলেই কী?”
“তুই বলতে চাস, তুই—তুই–”
“আমি কী?”
“তুই হিজল গাছে উঠতে পারবি?”
বকুল একটু চমকে উঠল। যখন জমিলা বুড়ি আশেপাশে নেই তখন তাকে অবিশ্বাস করা, তাকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করা এক কথা, আর যে-গাছটি একজন মানুষের জান কবজা করে পানিতে ভেসে যাবে সেই গাছে ওঠা সম্পূর্ণ অন্য ব্যাপার। বকুল থতমত খেয়ে চুপ করে রইল, তাই সিরাজে মুখে একটা বাঁকা হাসি ফুটে ওঠে, সে চোখ ছোট ছোট করে বলল, “পারবি না, না?”
বকুল একটা বড় নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, “কে বলেছে পারব না?”
সিরাজের চোখ গোল হয়ে যায়, “পারবি? হিজল গাছে উঠতে পারবি?”
“একশো বার।”
সিরাজ খানিকক্ষণ অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে বকুলের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “মিছিমিছি বলছিস, তাই না?”
“মিছিমিছি বলব কেন? চল আমার সাথে তোকে দেখাই!”
সিরাজ হঠাৎ ভয় পেয়ে গেল, বলল”থাক, দরকার নেই।”
বকুলের মুখ আরও শক্ত হয়ে যায়, “কেন দরকার নেই? ভাবছিস আমি ভয় পাব? কখনো না! আয় আমার সাথে।”
এবারে সিরাজ আরও ঘাবড়ে গেল, বলল, “ঠিক আছে যা, আমি বিশ্বাস করেছি তুই পারবি।”
“কেন তুই মিছিমিছি বিশ্বাস করবি? আয় আমি সত্যি সত্যি উঠে দেখাই।”
কাজেই ভরদুপুরবেলা বকুলের পিছুপিছু সিরাজ নদীর দিকে রওনা দিল। বাড়ির বাইরে আসতেই আরও কিছু বাচ্চাকাচ্চা পাওয়া গেল। কী করা হবে শুনতে পেয়ে তাদের আত্মা শুকিয়ে গেল, তারাও নানাভাবে বকুলকে শান্ত করার চেষ্টা করতে থাকে, কিন্তু কিছু-একটা বকুলের মাথায় ঢুকে গেলে সেটাকে বের করে আনা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। যখন বোঝা গেল সত্যি সত্যি বকুল হিজল গাছে উঠবেই তখন তারাও সাথে রওনা দিল–অন্তত ব্যাপারটা চোখে দেখা যাক। একজন মানুষ জীবনে আর কয়টা সাহসের কাজ দেখার সুযোগ পায়?
নদীর ঘাটে পৌঁছাতে পৌঁছাতে তাদের দল ভারী হয়ে আসে, দূর থেকে দেখে সেটাকে একটা ছোটখাটো মিছিলের মতো মনে হতে থাকে। সবার সামনে বকুল তার পিছুপিছু সিরাজ এবং তার পিছনে নানা বয়সের বাচ্চাকাচ্চা। খবর পেয়ে বকুলের ছোট ভাই শরিফও চলে এসেছে, সে অনেকক্ষণ থেকে বকুলকে বুঝিয়েও কোনো সুবিধে করতে না পেরে কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল, “আমি কিন্তু বাবাকে বলে দেব।”
বকুল উদাস গলায় বলল, “যা, বলে দে। তারপর দেখ তোকে আমি কী ধোলাই দিই।”
শরিফের বয়স আট, তার এই আট বছরের জীবনে সে তার বাবার ওপরে যেটুকু নির্ভর করে তার থেকে অনেক বেশি নির্ভর করে বকুলের উপর। কাজেই সে যে বকুলের ভোলাই খেতে চাইবে না সেটা বকুল খুব ভালো করে জানে।
শেষ পর্যন্ত দলটি হিজল গাছের কাছে হাজির হল। সবাই দূরে দল বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে, ভয় এবং উত্তেজনায় তারা নিঃশ্বাস পর্যন্ত ফেলতে ভুলে গেছে। বকুল ওড়নাটা ভালো করে পেঁচিয়ে নিয়ে কোমরে শক্ত করে বেঁধে প্রায় ছুটে এসে একটা ডাল ধরে নিজেকে ঝুলিয়ে একটা হ্যাঁচকা টানে উপরে উঠে গেল। দূরে যারা দাঁড়িয়েছিল তারা সবাই একসাথে বুক থেকে একটা নিঃশ্বাস বের করে দেয়। বকুল তরতর করে আরও খানিকটা উপরে উঠে হাত তুলে বলল, “কী দেখলি?”
সিরাজ ভয়-পাওয়া গলায় বলল, “দেখেছি। নেমে আয় এখন।”
বকুল কাঠবেড়ালির মতো আরও খানিক দূর উঠে গিয়ে নদীর দিকে তাকাল এবং হঠাৎ করে দূরে রাজহাঁসের মতো সাদা লঞ্চটা দেখতে পেল।
মাঝেমাঝেই নদীতে এই লঞ্চটা আসে, অন্য লঞ্চে যেরকম মানুষ গাদাগাদি করে থাক, ভটভট শব্দ করে কালো ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে যায়, এটা মোটেও সেরকম না। এটা একেবারে ধবধবে সাদা, প্রায় নিঃশব্দে পানি কেটে এগিয়ে যায়। লঞ্চটা দেখতেও অন্যরকম, একটা ছোট বাসার মতো। নিচে থাকার ঘর, উপরে পাটাতন, সেখানে আবার ঝালর-দেওয়া ছাদ। ঝলর-দেওয়া ছাদের নিচে এক-দুজন মানুষ থাকে, তাদের দেখেই বোঝা যায় তারা খুব সুখী। তাদের জামাকাপড়গুলো হয় সুন্দর, তাদের চোখে থাকে রঙিন চশমা, তারা নিজেদের মাঝে কথা বলে, হাসে। তারা হেসে হেসে কিছু-একটা খেতে খেতে নদীর তীরে তাকিয়ে থাকে। মানুষগুলোকে দেখে মনে হয় তারা বুঝি স্বপ্নজগতের মানুষ। এই লঞ্চটা এলেই বকুল সবসময় লঞ্চটার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, কারণ সে জানে এই লঞ্চে ঠিক তার বয়সী একটা মেয়ে থাকে। সে-মেয়েটা একেবারে পরীর মতো সুন্দর, গায়ের চামড়া যেন গোলাপ ফুলের মতো নরম, চুলগুলো একেবারে রেশমের মতো। হালকা রঙের একটা ফ্রক পরে মেয়েটা শান্তচোখে