ঠিক তখন দেখতে পেল পুতুলের মতো দেখতে আরেকটি মেয়ে স্টেজে উঠে গেছে, চিৎকার করে কিছু-একটা বলার চেষ্টা করছে সবাইকে। দর্শকেরা হঠাৎ মন্ত্রমুগ্ধের মতো চুপ করে গেল, তারা শুনতে চায় এই মেয়েটা কী বলবে।
নীলা চিৎকার করে বলল, “এই শুশুকটা বুনো শুশুক না। এটা পোষা শুশুক। এর নাম টুশকি।”
দর্শকেরা চিৎকার করে বলল, “শুনতে পাই না। মাইক্রোফোন, মাইক্রোফোন।”
নীলা নীল পোশাক পরা মানুষটার হাত থেকে মাইক্রেফোনটা প্রায় কেড়ে নিয়ে চিৎকার করে বলল, “এই শুশুকটা বুনো শুশুক না। এটা পোষা শুশুক। এর নাম টুশকি!”
দর্শকেরা আনন্দে চিৎকার করে উঠল, “টুশকি! টুশকি!”
সাথে সাথে টুশকি বকুলকে পিঠে নিয়ে আবার পানির ভিতর থেকে ভুস করে ভেসে উঠল উপরে।
“ওয়াটার ওয়ার্ল্ডের লোকেরা টুশকিকে চুরি করে এনেছে। চুরি করে এনে তাকে শাস্তি দিচ্ছে। কষ্ট দিচ্ছে, ইলেকট্রিক শক দিচ্ছে, আমরা একে ছাড়িয়ে নিতে এসেছি।”
দর্শকেরা চিৎকার করে উঠল, “ছেড়ে দাও! টুশকিকে ছেড়ে দাও।”
“টুশকি থাকে চন্দ্রা নদীতে। পুরো নদীতে সে ঘুরে বেড়ায়, তাকে ডাকলে সে আসে, সে খেলে, সে আমাদেরকে ভালোবাসে। আর এইযে দেখছেন বিদেশি মানুষ তারা গিয়ে টুশকিকে নদী থেকে ধরে এনেছে। সবাইকে বলছে এটা হিংস্র প্রাণী! টুশকি হিংস্র না। একটুও হিংস্র না।
“তাকে আমরা ছাড়িয়ে নিয়ে যাব। নিয়ে তাকে নদীতে ছেড়ে দেব। সে তার নদীতে ঘুরে বেড়াবে।”
উপস্থিত দর্শকেরা চিৎকার করে বলল, “ছেড়ে দাও! ছেড়ে দাও!”
তারপর প্রায় সাথে সাথেই ওয়াটার ওয়ার্ল্ডে ভাংচুর শুরু হয়ে গেল। লোকজন কিছু চেয়ার ভেঙে ফেলল, পর্দা ছিঁড়ে ফেলল, লাইট বাল্ব গুঁড়িয়ে দিল। ওয়াটার ওয়ার্ল্ডের লোকজনকে ধাওয়া করল। পানির ট্যাংকটা ভেঙে ফেলার চেষ্টা করে অবশ্যি বেশি সুবিধে করতে পারল না। ট্যাংকের পিছনে খুঁজে নীলা টুশকিকে নেওয়ার জন্যে একটা জিনিস পেয়ে গেল। একটা চটের থলের মতো। থলেটাকে ভালো করে ভিজিয়ে তার মাঝে টুশকিকে শুইয়ে বকুল নীলা তাকে টেনে নেওয়ার চেষ্টা করে, সাথে সাথে বেশ কয়েকজন মানুষ তাদেরকে সাহায্য করার জন্যে ছুটে এল।
মানুষজনের ভিড় দেখে টুশকি অশান্ত হয়ে ওঠে, লেজের আঘাতে সে দুই একজনকে একেবারে কাবু করে ফেলল। বকুল মাথায় হাত বুলিয়ে ক্রমাগত কথা বলে বলে কোনমতে তাঁকে শান্ত করার চেষ্টা করতে থাকে।
বাইরে নীলাদের গাড়ি রাখা ছিল। বড় একটা মাইক্রোবাস, ভিতরে অনেক জায়গা। পিছনের সিটে টুশকিকে শুইয়ে রাখা হল।
দর্শকদের একজন বলল, “পানির মাছ শুকনোয় মরে যাবে না?”
চশমা-পরা একজন বলল, “মরবে না। এটা তো মাছ না, এটা একটা প্রাণী। এটা নিঃশ্বাস নেয়।”
“নিঃশ্বাস নেয়?”
“হ্যাঁ, তবে পানির ভিতরে শরীরের ওজনটা টের পায় না, বাইরে ওজনটার জন্যে কষ্ট পাবে। তা ছাড়া–”
“তা ছাড়া কী?” “শরীরটা যেন শুকিয়ে না যায়। নদীতে গিয়ে ছেড়ে না দেওয়া পর্যন্ত শরীরটাকে পানি দিয়ে ভিজিয়ে রাখতে হবে।”
সাথে সাথে উৎসাহী দর্শকদের একজন একটা বালতি করে পানি নিয়ে এল মাইক্রোবাসের ভিতরে।
গাড়িতে ড্রাইভারের পাশে বসেছে শমসের। তার মুখে কখনো কোনো অনুভূতির চিহ্ন পড়ে না, এখনও মুখের ভাব দেখে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। নীলা আর বকুল টুশকির পাশে বসেছে। টুশকির গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে বলল, “ড্রাইভার চাচা, চলেন।
“কোথায়?”
“লঞ্চঘাটে।”
অসংখ্য দর্শক তখনও হৈচৈ করছে তার মাঝে ভিড় ঠেলে মাইক্রোবাসটা বের হয়ে এল। গাড়িটা বড় রাস্তায় ওঠার পর শমসের একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “ব্যাপারটা সামলানো কঠিন হবে।”
নীলা আর বকুল দুজনেরই নিজেদের যুদ্ধবিজয়ী বীরের মতো মনে হচ্ছিল তারা একটু অবাক হয়ে বলল, “কোন্ ব্যাপারটা?”
“এই যে টুশকিকে নিয়ে যাচ্ছি।”
“কেন?”
“মনে হয় না আমরা লঞ্চঘাটে যেতে পারব। তার আগেই আমাদেরকে ধরবে।”
“কে ধরবে?”
“পুলিশ। কিংবা মিলিটারি। ওয়াটার ওয়ার্ল্ডের মালিক খুব শক্তিশালী মানুষ। আমাদের আবার কোন বিপদ না হয়।”
শমশেরের গলার স্বর শুনে নীলা হঠাৎ ভয় পেয়ে যায়। শুকনো গলায় বলল, “কী বিপদ?”
“এদের সাথে আসলে অর্গাইনাইজড ক্রিমিনালের দলের যোগাযোগ আছে। এরা ইচ্ছে করলে অনেক কিছু করে ফেলতে পারে।”
“তা হলে আমরা কী করব শমসের চাচা?”
“দেখি কী করা যায়।”
শমসের চিন্তিত মুখে বসে বসে কিছু–একটা ভাবতে লাগল। হাতে একটা সেলুলার ফোন ছিল, সেটা দিয়ে কোথায় কোথায় জানি ফোন করল। বাইরে তখন অন্ধকার নেমে এসেছে। হেডলাইটের উজ্জ্বল আলোতে অন্ধকার কেটে কেটে মাইক্রোবাসটি ছুটে চলছে নদীর দিকে।
শমশেরের আশঙ্কাকে অমূলক প্রমাণ করে মাইক্রোবাসটি একেবারে নদীর ঘাটে চলে এল। নীলাদের সাদা লঞ্চটি এখানে বাঁধা আছে, পাশে একটি ছোট কাজ চালানোর মতো জেটি। যখন মাইক্রোবাসের দরজা খুলে টুশকিকে ধরাধরি করে তারা নদীর দিকে যাচ্ছে ঠিক তখন যেন মাটি খুঁড়ে ডজনখানেক মানুষ তাদেরকে ঘিরে দাঁড়াল। নীলা ভয়ে চিৎকার করে উঠে বলল, “কে?”
অন্ধকারে সামনাসামনি দাঁড়ানো একজন মানুষ এগিয়ে এসে বলল, “আমরা স্পেশাল ব্রাঞ্চের লোক। আমাদের কাছে রিপোর্ট এসেছে ওয়াটার ওয়ার্ল্ডের পানির ট্যাংক থেকে একটা শুশুককে চুরি করা হয়েছে।”