স্টেজে নীল পোশাক পরা একজন মানুষ এসে দাঁড়াল, এক হাতে চাবুকের মতো একটা জিনিস। অন্য হাতে একটা মাইক্রোফোন। মানুষটি স্টেজে এসে দাঁড়াতেই উপস্থিত সব দর্শকেরা আনন্দে হাততালি দিতে শুরু করে। মানুষটা মাথা নুইয়ে সবার করতালি গ্রহণ করে বলল, “আপনারা এখন দেখতে পাবেন এক অভূতপূর্ব খেলা। লস এঞ্জেলস, ফ্লোরিডা, ভ্যানকুবারে ডলফিনের খেলা দেখানো হয়। আমরাও বাংলাদেশে আমাদের নিজস্ব ডলফিন শুশুকের খেলা দেখানোর ব্যবস্থা করেছি। আপনারা দেখবেন পানির বিস্ময় এই শুশুকের বিচিত্র খেলা।”
বকুল আবার উঠে দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল, নীলা তাকে আবার টেনে বসিয়ে দিল। মানুষটি মাইক্রোফোনে বলল, “এই শুশুকটি আনা হয়েছে চন্দ্রা নদী থেকে। এটি একটি মেয়ে-শুশুক, এর ওজন প্রায় একশো কেজি এবং যে-জিনিসটা আপনাদের সবাইকে বলে রাখছি সেটা হল এটা একটা বন্য শুশুক। এটা বেপরোয়া শুশুক। এটা একটা খ্যাপা শুশুক!
“মানুষ বন্য হাতিকে পোষ মানায়, বন্য বাঘকেও পোষ মানায়। আমরা এই বন্য শুশুককেও পোষ মানানো শুরু করেছি। এটি লাফিয়ে রিঙের ভিতর দিয়ে পার হবে, একটা বলকে ছুঁড়ে দেবে, শূন্যে ডিগবাজি দেবে। যখন এটাকে পোষ মানানো হবে তখন সে আরও বিচিত্র খেলা দেখাবে। সেইসব খেল দেখার জন্য আপনাদেরকে এখনই আমন্ত্রণ জানিয়ে রাখছি।
“বন্য শুশুককে পোষ মানানো খুব সহজ নয়। এটাকে দেখলেই বুঝতে পারবেন এর শরীরে হিংস্র সিংহের শক্তি। লেজ দিয়ে আঘাত করে মানুষের মেরুদণ্ড ভেঙে দিতে পারে, মুখের কামড়ে শরীর ক্ষতবিক্ষত করে দিতে পারে। শক্তিশালী মাথা দিয়ে মানুষকে পিষে ফেলতে পারে।
“এই ভয়ংকর জলজন্তুকে আমরা পোষ মানানো শুরু করেছি। সেই পোষ মানানোর জন্যে সুদূর আমেরিকা থেকে এসেছেন পি-টা-র-ব্লাংক! আপনারা করতালি দিয়ে এই মানুষটাকে অভ্যর্থনা জানান।”
সাথে সাথে পানির ট্যাংকে দ্বীপের মতো একটা জায়গায় একজন বিদেশি মানুষ এসে দাঁড়াল, তার শরীরে কালো রঙের বরারের একধরনের পোশাক। তার হাতেও চাবুকের মতো একটা জিনিস। সবাই প্রচণ্ড জোরে হাততালি দিতে শুরু করে।
মাইক্রোফোন-হাতের মানুষটা আবার কথা বলতে শুরু করল, “পিটার ব্ল্যাংক পৃথিবীর একজন সর্বশ্রেষ্ঠ ডলফিন-প্রশিক্ষক। তার হাতে রয়েছে ইলেকট্রিক চাবুক। যখন এই ভয়ংকর শুশুক তার কথার অবাধ্য হয় তিনি এই ইলেকট্রিক চাবুকের তিন হাজার ভোল্ট দিয়ে তাকে আঘাত করেন। হিংস্র শুশুক তখন নিরীহ মোরগছানায় পালটে যায়!”
মানুষটা মোরগছানার কথা বলার সময় হেসে উঠল এবং তার কথায় দর্শকেরাও আনন্দে হেসে ওঠে। মানুষটা এবারে হাত তুলে বলল, “এখন দেখবেন বন্য শুশুকের খেলা!”
সাথে সাথে প্রচণ্ড জোরে একধরনের আদিম বাজনা বাজতে শুরু করে, পিটার ব্ল্যাংক তার ইলেকট্রিক চাবুক ঘোরাতে শুরু করে এবং টুশকি ভয় পেয়ে পানি থেকে লাফিয়ে উপরে উঠে আসে। দর্শকেরা আনন্দে হাততালি দিতে শুরু করল।
উপর থেকে একটা রিং ঝুলিয়ে দেওয়া হল, সেখানে কাপড় প্যাচানো, একটা দেয়াশলাই দিয়ে সেটাতে আগুন ধরিয়ে দিতেই পুরো রিংটা দাউদাউ করে জ্বলতে শুরু করে। শব্দ আরও দ্রুত হতে থাকে, সবাই দেখতে পায় শুশুকটা পানির ট্যাংকে পাগলের মতো ঘুরছে, পিটার ব্ল্যাংক চাবুক দিয়ে আঘাত করতেই একটা আর্তচিৎকারের মতো শব্দ করে শুশুকটা লাফিয়ে আগুনের রিঙের ভিতর দিয়ে যেতে চেষ্টা করে, সেটা ভিতর দিয়ে যেতে পারল না–জ্বলন্ত রিঙে আঘাত করে আবার পানিতে পড়ে গেল।
বকুল আর নিজেকে সামলে রাখতে পারল না।”না-না-না–” বলে চিৎকার করতে করতে সে স্টেজের দিকে ছুটে যেতে থাকে। ছোট একটা মেয়েকে চিৎকার করে যেতে দেখে দর্শকেরা হতচকিত হয়ে গেল। ওয়াটার ওয়ার্ল্ডের লোকজন তাকে ধরার জন্যে ছুটে আসতে থাকে, তার আগেই বকুল পেক্সি গ্লাসের দেয়াল বেয়ে উপরে উঠে গেছে। পানির ট্যাংকের দেয়ালে দাঁড়িয়ে সে চিৎকার করে ডাকল, “টুশকি!”
গ্যালারিভরা অসংখ্য দর্শক অবাক হয়ে দেখল শুশুকটি হঠাৎ তীরের মতো ছুটে আসে বকুলের দিকে। বকুল প্লেক্সি গ্লাসের দেয়াল থেকে নিচু পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। পানি ছিটিয়ে পড়ল চারদিকে, তার মাঝে সবাই স্পষ্ট দেখতে পায় মাছের মতো সাঁতার কাটছে বাচ্চা একটা মেয়ে আর বিশাল একটা শুশুক এসে তাকে স্পর্শ করছে। মায়েরা যেভাবে সন্তানকে আলিঙ্গন করে ঠিক সেরকম ভালোবাসায় মেয়েটি আলিঙ্গন করছে শুশুকটিকে, দুজনে জড়াজড়ি করে পানির নিচে ঘুরপাক খেতে থাকে, ডিগবাজি খেতে থাকে। শুশুকটি তার মুখ দিয়ে বাচ্চা মেয়েটিকে আদর করতে থাকে আর গভীর ভালোবাসায় মেয়েটি শুশুকের সারা শরীর হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। শুশুকটি মেয়েটিকে নিয়ে পানির ট্যাংকে ঘুরে বেড়াতে থাকে, আর মেয়েটি আদর করে তাকে জড়িয়ে ধরে রাখে। সবাইকে অবাক করে মেয়েটাকে পিঠে নিয়ে শুশুকটা হঠাৎ পানি থেকে লাফিয়ে উঠে আবার পানির গভীরে চলে যায়।
উপস্থিত দর্শকেরা প্রথমে হতচকিত হয়ে বসে থাকে কয়েক মুহূর্ত, তারপর প্রচণ্ড জোরে হাততালি দিয়ে আনন্দধ্বনি দিতে থাকে। ওয়াটার ওয়ার্ল্ডের দুজন মানুষ স্টেজে দাঁড়িয়ে থাকে বোকার মতো, কী করবে বুঝতে পারছে না তারা। মাইক্রোফোন-হাতের মানুষটি কয়েকবার উপস্থিত দর্শকদের শান্ত করার চেষ্টা করল, কিন্তু কাউকে শান্ত করানোর কোনো উপায়ই নেই। দর্শকেরা এরকম দৃশ্য আগে কখনো দেখেনি।