বকুল মাথা নাড়ল। নীলার আব্বু নিশ্চয়ই কিছু-একটা ব্যবস্থা করতে পারবেন, সে-ব্যাপারে বকুলের কোন সন্দেহ নেই।
নীলা একটু ইতস্তত করে বলল, “শুধু একটা সমস্যা।”
“কী সমস্যা?”
“আব্বু ঢাকায় নেই।”
“কোথায় গিয়েছেন?”
“সিঙ্গাপুর।”
“কবে আসবেন?”
নীলা মাথা চুলকে বলল, “জানি না।”
ঢাকার রাস্তায় গাড়ি দুজনকে নিয়ে যেতে থাকে, নীলা হাতে কিল দিয়ে বলল, “আমাদেরই একটা ব্যবস্থা করতে হবে।”
বকুল ভয়ে ভয়ে বলল, “আমাদেরকেই?”
“হ্যাঁ, আমাদেরকেই। আমাকে আর তোমাকে।”
নীলাদের বাসায় পৌঁছে বকুল একেবারে হতবাক্ হয়ে গেল। মানুষের বাসা যে কখনো এত সুন্দর হতে পারে সেটা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। বাসার এক-একটা বাথরুম এত বড় যে মনে হয় ভিতরে ফুটবল খেলা যায়। বকুল হাত-মুখ ধুয়ে যে-তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছল সেটা এত নরম যে মনে হল বুঝি ফুলের পাপড়ি দিয়ে তৈরি। বকুল আর নীলা যে খাবারের টেবিল খেতে বসল সেটা কুচকুচে কালো পাথরের তৈরি। টেবিলটি এত মসৃণ যে শুধু হাত বুলাতে ইচ্ছে করে।
বকুল আর নীলা খেতে খেতে আলাপ করতে থাকে। নীলা বলল, “আব্বু নেই তাই খুব মুশকিল হল কিন্তু আল্লু থাকলে যেটা করতেন আমরা সেটাই করব।–”
“সেটা কী?”
“শমসের চাচা!”
নীলা তখন গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে লাগল, “শমসের চাচা শমসের চাচা!’
সাথে সাথে প্রায় নিঃশব্দে শমসের এসে ঢুকল, বলল, “আমাকে ডাকছ নাকি নীলা?”
“হ্যাঁ শমসের চাচা। বকুল একটা খবর নিয়ে এসেছে, একেবারে সর্বনাশ হয়ে গেছে।”
“কী খবর?”
“টুশকির কথা মনে আছে না? সেটা চুরি হয়ে গেছে।”
শমসের চাচা নিজের নখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “হ্যাঁ। আমি টেলিভিশনে দেখেছি। ওয়াটার ওয়ার্ল্ড নাম দিয়েছে, সেখানে শুশুকদের খেলা দেখানো হয়।”
নীলা চোখ বড় বড় করে বলল, “হ্যাঁ, সেখানে টুশকিকে চুরি করে এনেছে।”
শমসের কোনো কথা না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। নীলা বলল, টুশকিকে উদ্ধার করতে হবে শমসের চাচা। কতক্ষণ লাগবে?”
শমসের চাচা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “টুশকিকে এত সহজে উদ্ধার করা যাবে না নীলা।”
নীলা ভয়-পাওয়া গলায় বলল, “কেন?”
“টুশকি কারও সম্পত্তি ছিল না। সেটা নদীর একটা শুশুক। নদীর যে-কোন মাছ যেমন ধরা যায় ঠিক সেরকম যে-কোন শুশুকও ধরে আনা যায়–”
বকুল প্রায় আর্তনাদ করে বলল, “টুশকি আমাদের শুশুক। আমাদের–আমার–”
শমসের একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, “আমি জানি। কিন্তু আইনের দিক দিয়ে তোমার ছিল না। এখন এটা আইনের দিক দিয়ে ওয়াটার ওয়ার্ল্ডের। তারা যদি ছেড়ে না দেয় আমাদের কিছু করার নেই।”
নীলা প্রায় কেঁদে ফেলে বলল, “কিছু করার নেই?”
শমসের একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “না, নেই। স্যার যদি থাকতেন তা হলে কিছু করতে পারতেন।
“শমসের চাচা! আবুকে এক্ষুনি ফোন করেন। এক্ষুনি।
০৯. ওয়াটার ওয়ার্ল্ডে টুশকি
বিকেল পাঁচটার সময় ওয়াটার ওয়ার্ল্ডে টুশকির একটা অনুষ্ঠান রয়েছে, নীলা আর বকুল সেটা দেখতে যাবে। একেবারে সামনে বসে দেখার জন্যে দুইটা টিকেট কেনা হয়েছে। ওয়াটার ওয়ার্ল্ডে এসে বকুল একেবারে হতবাক হয়ে গেল, এত সুন্দর যে একটা জায়গা হতে পারে নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা সম্ভব না। বেহেশত মনে হয় এরকম হবে। নীলা পৃথিবীর অসংখ্য জায়গা দেখেছে, তাকেও স্বীকার করতে হল জায়গাটা সুন্দর। বিরাট জায়গা নিয়ে এটা তৈরি করা হয়েছে। সামনে প্লেক্সি গ্লাসের বিশাল একটা ট্যাংক, তার সামনে গ্যালারির মতো চেয়ার উঠে গেছে। ট্যাংকটা একটা বড় সাইজের পুকুরের মতো, তার মাঝখানে দ্বীপের মতো জায়গা ভেসে আছে, সেখানে উজ্জ্বল রঙের নকশা। পুরো এলাকাটা উজ্জ্বল আলোতে আলোকিত করে রাখা আছে, দেখেই চোখ ধাঁধিয়ে যায়। ভিতরে বিশাল স্পিকারে দ্রুত লয়ে বাজনা বাজছে, পুরো এলাকাটাতে একটা উৎসব উৎসব ভাব।
বকুল আগে কখনো এরকম জায়গায় আসেনি, সবকিছু দেখে সে হতবাক হয়ে গেল। বিশাল গ্যালারির মতো জায়গা, সেখানে আস্তে আস্তে মানুষজন এসে নিজেদের জায়গায় বসে। যারা এসেছে তাদের মাঝে কমবয়সী বাচ্চারাই বেশি। টিকেটের অনেক দাম, যারা আসতে পারে তাদের সবাই বড়লোকের ছেলেমেয়ে, চেহারায় জামাকাপড় সেটা বেশ স্পষ্ট।
ঠিক পাঁচটার সময় অনুষ্ঠান শুরু হল। নানারকম অনুষ্ঠান রয়েছে, ম্যাজিক শো, হাস্যকৌতুক, বানরের খেলা, পাখির খেলা, শারীরিক কসরত, নাচ-গান সবকিছুর শেষে হচ্ছে শুশুকের খেলা। অনুষ্ঠানগুলো ভালো–অন্য যে-কোন সময় হলে দেখে বকুল হেসে কুটিকুটি হত, কিন্তু এখন ভিতরে অশান্তি তাই একটা অনুষ্ঠানও সে মন দিয়ে দেখতে পারল না।
সবকিছুর শেষে হঠাৎ স্টেজে বিচিত্র একধরনের বাজনা বাজতে শুরু করে। সাথে সাথে পানির ট্যাংকের এক পাশে একটা গেট খুলে দেওয়া হল। বকুল প্লেক্সি গ্লাসের স্বচ্ছ দেয়ালের ভিতর দিয়ে দেখতে পেল একটা শুশুক দ্রুতবেগে পানির ট্যাংকে এসে হাজির হয়েছে। শুশুকটা এসে সজোরে দেয়ালে আঘাত করে, যেন সেটা ভেঙে ফেলতে চায়। বকুল উত্তেজনায় তার চেয়ারে দাঁড়িয়ে গেল–তার টুশকি!
নীলা ওর হাতে ধরে টেনে বসিয়ে দিল। বকুল বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকে, টুশকি পাগলের মতো ভিতরে ছোটাছুটি করছে, দেয়ালে ধাক্কা দিচ্ছে, মাঝে মাঝে হঠাৎ লাফিয়ে উঠছে। সবাই মনে করছে এটা একধরনের খেলা, শুধু বকুল জানে এটা খেলা নয়, এটা একধরনের ক্রোধ। যে-টুশকি বিশাল নদীতে ঘুরে বেড়াত তাকে হঠাৎ করে এইটুকুন জায়গায় আটকে ফেললে সে কি সেটা সহ্য করতে পারে?