রাতে বিছানার শুয়ে শুয়ে বকুল কীভাবে কী করবে চিন্তা করতে থাকে। একা একা ঢাকা পৌঁছানো মনে হয় সবচেয়ে কঠিন অংশটুকু। সে যদি মেয়ে না হয়ে ছেলে হত তা হলে কোন সমস্যাই ছিল না। বারো-তেরো বছরের একটা মেয়ে একা একা ঢাকা যায় না, কিন্তু তাকে যেতেই হবে। তাদের স্কুল থেকে মাইলখানেক উত্তরে ঢাকা যাবার রাস্তা, সেখানে ঢাকা যাবার বাস থামে। কোনভাবে সেটাতে উঠে পড়লে একটা-কিছু ব্যবস্থা হয়ে যাবে। সঙ্গে আর কাউকে নিতে পারলে হত, কিন্তু চিন্তা-ভাবনা করে সে একাই যাবে বলে ঠিক করল। ঢাকা যাবার জন্যে কিছু টাকা-পয়সা দরকার, সে তার পয়সা জমানোর কৌটায় যে পয়সা জমিয়ে এসেছে সেটা মনে হয় যথেষ্ট নয়। বাজারে রহমত চাচার মনোহারী দোকান থেকে বাবার কথা বলে কিছু টাকা ধার করা যেতে পারে, বেশ কিছুদিন আগে একবার বাবা তাকে দিয়ে কিছু টাকা আনিয়ে নিয়েছিলেন। স্কুলের বেতনের কথা বলে মায়ের কাছ থেকেও কিছু টাকা নেওয়া যেতে পারে।
পরদিন সকালে স্কুলে যাবার কথা বলে সে তাদের গ্রামের অন্য বাচ্চাদের সাথে বের হল। মাকে স্কুলের বেতনের কথা বলে কিছু টাকা নিয়েছে। নিজের জমানো খুচরাও টাকাও আছে সাথে। বাজারের পাশ দিয়ে যাবার সময় বাবার কথা বলে রহমত চাচার কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে নিল। এখন ঢাকা যাওয়ার এবং ঢাকায় পৌঁছানোর পর নীলার বাসায় যাবার জন্যে রিকশা ভাড়াটুকু উঠে গেছে মনে হয়। স্কুলের কাছাকাছি পৌঁছে সে তার বই-খাতা রতনের কাছে দিয়ে বলল বিকেলবেলা সেগুলো তার বাসায় পৌঁছে দিতে।
রতন চোখ কপালে তুলে বলল, “সে কী! তুমি কোথায় যাচ্ছ বকুলাপ্পু?”
“ঢাকায়।”
“ঢাকায়? কার সাথে?”
“একা।”
রতন মুখ হাঁ করে বলল, “একা?”
“হ্যাঁ। টেলিভিশনে দেখিসনি টুশকিকে চুরি করে নিয়েছে?”
রতন মাথা নাড়ল, সে নিজে দেখেনি, কিন্তু ঘটনাটার কথা শুনেছে। সে ঢোক দিলে বলল, “তুমি কী করবে?”
“টুশকিকে বাঁচাতে হবে না?”
“কেমন করে বাঁচাবে?”
“সময় হলেই জানবি। যদি বিকেলের মাঝে ফিরে না আসি তা হলে বাড়িতে বলিস আমি নীলাদের বাসায় গেছি।”
“তোমার বাড়িতে চিন্তা করবে না বকুলাপ্পু?”
“সেটা তো করবেই। বলিস নীলা আর তার আব্বু গাড়ি করে এসে আমাকে নিয়ে গেছে। তা হলে বেশি চিন্তা করবে না। বলতে পারবি না?”
রতন দুর্বল গলায় বলল, “পারব।”
“যদি না বলিস তোর মাথা ছিঁড়ে ফুটবলের মতো কিক দিয়ে নদীর ঐ পাড় পাঠিয়ে দিব। মনে থাকে যেন।”
রতন আবার ঢোক গিলে বলল তার মনে থাকবে।
ঢাকায় যাবার অংশটুকু নিয়ে সে যত ভয় পেয়েছিল দেখা গেল ব্যাপারটা তত কঠিন হল না। ছাদে এবং ভিতরে মানুষে বোঝাই গাদাগাদি ভিড়ের একটা বাসে উঠে যাবার সময় সবাই মনে করতে লাগল সে কারও সাথে উঠেছে। কন্ডাক্টর ভাড়া নেবার সময় বুঝতে পারল সে একা–তখন বকুল ভান করতে লাগল তার সাথে যে এসেছে সে বাসের ছাদে উঠেছে। কন্ডাক্টর ভাড়া পেয়েই খুশি, কার সাথে সে এসেছে, কে ছাদে উঠেছে এবং কে নিচে বসেছে সেটা নিয়ে মাথা ঘামাল না।
ঢাকা শহরে নেমে নীলার বাসায় যাওয়া নিয়ে একটা বড় সমস্যা হল। যেখানে বাসে নেমেছে সেখান থেকে কোন রিকশাই নীলাদের এলাকায় যেতে রাজি হল না–সেটা নাকি অনেক দূর। কী করবে সেটা নিয়ে যখন বকুল খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে তখন হঠাৎ করে তার ফোন করার কথা মনে পড়ল। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে সে একটি দোকান পেয়ে গেল যার বাইরে বড় বড় করে লেখা ‘ফোন ফ্যাক্স’। ভিতরে ঢুকে মানুষটাকে নীলাদের বাসার টেলিফোন নম্বরটা দিতেই মানুষটা তাকে নম্বরটা ডায়াল করে টেলিফোনটা এগিয়ে দিল। বকুল এর আগে জীবনে টেলিফোনে কথা বলেনি, কী করতে হয় সে জানেও না। রিসিভারটা কানে লাগিয়ে সে কিছু-একটা শোনার চেষ্টা করতে থাকে, খানিকক্ষণ পিপি একটা শব্দ হয়ে হঠাৎ সে একটা মেয়ের গলায় শব্দ শুনতে পেল, “হ্যালো!”
“নীলা?”
“হ্যাঁ, আপনি কে বলছেন?”
“নীলা, আমি বকুল।”
“বকুল!” টেলিফোনে নীলা একটা বিকট চিৎকার দিল”তুমি কোথা থেকে কথা বলছ?”
“ঢাকা থেকে।”
“ঢাকা কোথায়? কার কাছে এসেছ? কখন এসেছ?”
“একসাথে এত কিছু জিজ্ঞেস কোরো না। আমি এক্ষুনি এসেছি।”
“কার কাছে?”
“তোমার কাছে। খুব দরকার।” নীলা শঙ্কিত গলায় বলল, “কী হয়েছে?”
“টুশকি চুরি হয়ে গেছে।”
“কী বললে? নীলা চিৎকার করে বলল, “কী বললে?”
“টুশকিকে চুরি করে নিয়ে গেছে। আমি টেলিভিশনে দেখেছি।”
“কোথায় দেখেছ–দাঁড়াও তুমি কোথায়?”
“আমি জানি না।”
“কোথা থেকে ফোন করছ?”
“একটা দোকান থেকে।”
“দোকানটা কোথায়?”
“সেটাও জানি না।”
“তুমি দোকানের মানুষের কাছে টেলিফোনটা দিয়ে এখানে বসে থাকো আমি গাড়ি নিয়ে আসছি। অন্য কোথাও যাবে না। ঢাকা শহরে কেউ হারিয়ে গেলে তাকে আর পাওয়া যায় না।”
“ঠিক আছে।”
নীলা ফোনের দোকানের মানুষের সাথে কথা বলে ঠিকানাটা নিয়ে আধঘণ্টার মাঝে বিশাল একটা গাড়ি নিয়ে চলে এল। গাড়ি করে যেতে যেতে বকুলের কাছে সবকিছু শুনতে শুনতে নীলার চোখ বড় বড় হয়ে ওঠে। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে হাতে কিল মেরে বলল, “কত বড় সাহস দেখেছ! আমাদের টুশকিকে চুরি করে নিয়ে যায়!”
“এখন কী করবে?”
“তুমি কোন চিন্তা করবে না, আমি সব ব্যবস্থা করব। আল্লুকে বললেই দেখো আব্বু একটা ব্যবস্থা করে দেবে।”