দেশি সাহেবটা অবাক হয়ে বকুলের দিকে তাকিয়ে রইল। তার মুখে অপমানের একটা ছায়া পড়েছে। মানুষটা বকুলের দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বলল, “তু-তু-তুই–”
বকুল মুখ শক্ত করে বলল, “তুই না। তুমি।”
মানুষটির মুখ অপমানে লাল হয়ে যায়। একবার ঢোক দিলে বলল, “মানে বলছিলাম আমার ব্যাগে আসলে টাকা নেই–তাই মানে তোকে–মানে তোমাকে”
বকুল বলল, “আপনার সাথে আমার কথা বলার সময় নেই, স্কুলের পড়া করতে হবে–আমি গেলাম।”
তারপর মানুষটাকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বাড়ির ভিতরে চলে আসে, রাগে দুঃখে অপমানে তার চোখে পানি এসে যেতে চায়। তাকে ঘিরে যদি এতগুলো মানুষ না থাকত তা হলে সে কি খামচি দিয়ে লোকটার মুখ আঁচড়ে দিত না?
০৮. প্রথম দিন বকুল
প্রথম দিন বকুল ব্যাপারটাকে বেশি গুরুত্ব দিল না। হিজল গাছটার ডালটাকে পানিতে ঝাঁপটিয়ে শব্দ করার পরেও টুশকি এল না। হতে পারে নদীর নিচে কিংবা এত দূরে কোথাও গেছে যে তাকে যে ডাকা হচ্ছে সেটা সে শুনতে পায়নি।
দ্বিতীয় দিনে ব্যাপারটিতে বকুল বেশ চিন্তার মাঝে পড়ে যায়। সারাদিনই সে ছাড়াছাড়া ভাবে টুশকিকে ডেকেছে কিন্তু টুশকির দেখা নেই। তৃতীয় দিন বকুল ঘুম থেকে উঠল একটা চাপা দুশ্চিন্তা নিয়ে, যদি আজকেও টুশকিকে পাওয়া না যায়?
সত্যি সত্যি সারাদিন টুশকিকে ডাকাডাকি করেও কোন লাভ হল না। বকুলের ইচ্ছে হল সে চিৎকার করে কাঁদে। বিকেলবেলা যখন কেউ আশেপাশে নেই তখন সে সত্যি সত্যি খানিকক্ষণ কাঁদল। কোথায় গেল তার টুশকি? তাকে ছেড়ে চলে গেছে সেটা তো হতে পারে না।
দেখতে দেখতে আরও দুদিন কেটে গেল, এখনও টুশকির কোন দেখা নেই। বকুল শুকনো-মুখে নদীর তীরে ঘুরোঘুরি করে, নদীর পানিতে পা ভিজিয়ে বসে থাকে, হিজল গাছের ডাল পানিতে ঝাঁপটিয়ে শব্দ করে। সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সত্যি টুশকি হারিয়ে গেছে, আর কোনদিন তাকে ফিরে পাবে না। বুকের ভিতরটা তার মোচড় দিতে থাকে, গভীর রাতে ঘুম ভেঙে যায়, সে বিছানায় উঠে বসে থাকে। জানালা দিয়ে সে নদীর দিকে তাকিয়ে থাকে, না জানি কোথায় কোন্ বিপদে পড়েছে টুশকি!
এক সপ্তাহ পর এক শুক্রবার সন্ধ্যেবেলা শরিফ ছুটতে ছুটতে এল বকুলের কাছে, দৌড়ে এসে হাঁপিয়ে গেছে, নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। কিছু-একটা বলতে চাইছে কিন্তু উত্তেজনায় বলতে পারছে না কিছু। বকুল ভয়-পাওয়া গলায় বলল, “কী হয়েছে?”
“টুশকি!”
“টুশকি? কোথায়?”
“টেলিভিশনে।”
“টেলিভিশনে?”
“হ্যাঁ।” শরিফ লম্বা একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, “মণ্ডলবাড়িতে টেলিভিশনে খবরে টুশকিকে দেখিয়েছে। ঢাকায় টুশকিকে নিয়ে একটা সার্কাস হচ্ছে।”
“সার্কাস?”
“হ্যাঁ।”
বকুল হতবাক হয়ে বসে রইল। পুরো ব্যাপারটা এখনও তার বিশ্বাস হচ্ছে না, তাদের টুশকিকে ধরে নিয়ে সেটা দিয়ে সার্কাস দেখানো হচ্ছে! বকুল আবার জিজ্ঞেস করল, “তুই নিজে দেখেছিস?”
“আমি নিজে দেখেছি।” শরিফ বুকে থাবা দিয়ে বলল, “খোদার কসম।”
বাংলা খবরে যেটা বলা হয় সেটা রাত দশটার ইংরেজি খবরেও বলা হয় কাজেই রাত দশটার সময় বকুল মণ্ডলবাড়িতে হাজির থাকল। মণ্ডলবাড়িতে টেলিভিশন আছে, সেটা দেখতে গ্রামের অনেক মানুষ এসে ভিড় জমায়, বাইরের ঘরে মানুষ গিজগিজ করতে থাকে, তার মাঝে বকুল খানিকটা জায়গা করে নিল। ইংরেজি খবর শুনে কেউ বিশেষ কিছু বোঝে না বলে অনেকেই তখন চলে গেল, বকুল সুযোগ পেয়ে একেবারে কাছে এসে অপেক্ষা করতে থাকে। সত্যি সত্যি খবরের শেষের দিকে হঠাৎ করে টেলিভিশনে টুশকিকে দেখানো হল, টুশকি পানির মাঝে ভুস করে বের হয়ে আসছে, অসংখ্য মানুষ হাততালি দিচ্ছে। তারপর খবরের একজন মানুষ কয়েকজন সাক্ষাৎকার নিল, খবরটি ইংরেজি হলেও সাক্ষাৎকারটি বাংলা। বকুল শুনতে পেল মানুষগুলো বলছে যে বিদেশে যেরকম ডলফিনের খেলা দেখানো হয় তারাও সেরকম বাংলাদেশের নিজস্ব সম্পদ শুশুকের খেলা দেখাচ্ছে। তারা আপাতত একটি শুশুক দিয়ে শুরু করছে, কয়েকদিনের মাঝেই আরও শুশুক নিয়ে আসবে। যে-মানুষটি সাক্ষাৎকার নিচ্ছে সে তখন জিজ্ঞেস করল, “আপনারা কীভাবে শুশুককে খেলা দেখানো শিখাচ্ছেন?”
”আমাদের সেজন্যে বিদেশ থেকে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মানুষ আনা হয়েছে, তাদের একজন হচ্ছেন পিটার ব্ল্যাংক।”
তখন পিটার ব্ল্যাংককে দেখানো হল এবং বকুল চমকে উঠে দেখল পিটার ব্ল্যাংক হচ্ছে ঝড়ের মাঝে স্পিডবোট ডুবে-যাওয়া যে-মানুষটিকে সে উদ্ধার করেছিল সে। খবরের প্রতিবেদন আরও অনেক কিছু বলা হল, যে-প্রতিষ্ঠানটি বিনোদনের জন্যে এই খেলা দেখাচ্ছে তাদের নাম ‘ওয়াটার ওয়ার্ল্ড। তাদের খেলা দেখানো হয় প্রতিদিন বিকাল পাঁচটা এবং সন্ধ্যে সাতটার সময়। যেখানে খেলাটি দেখানো হচ্ছে সেই জায়গাটি নাম ‘উত্তরণ’, বনানীর কাছাকাছি সেটি একটি নতুন এলাকা।
পলাশপুর গ্রামের সবাই বকুলকে এবং টুশকিকে দেখেছ কাজেই সবাই টেলিভিশনের টুশকিকে চিনতে পারল। তারা এমন ভান করতে লাগল যে এটা টুশকির বিশাল একটা সৌভাগ্য যে তাকে টেলিভিশনে দেখানো হচ্ছে। নদী থেকে তাকে ধরে নেওয়া যে একটা অন্যায় কাজ সেটা একজনও বুঝতে পারল না। মণ্ডলবাড়ি থেকে বকুল প্রায় চোখ পানি নিয়ে বের হল। অন্ধকার পথে বাড়ি ফিরে আসতে আসতে বকুল ঠিক করে ফেলল সে কাল ভোরেই ঢাকা যাবে। নীলাকে ঘটনাটা খুলে বললে নীলার আব্বু নিশ্চয়ই কিছু-একটা ব্যবস্থা করতে পারবেন। তার কাছে নীলার ঠিকানা আছে, ঢাকা শহরে গেলে নীলার বাসা খুঁজে বের করা কঠিন হবার কথা নয়।