মানুষ দুটি ভেসে ভেসে যেখানে চলে যেতে পারে মোটামুটি সেদিকে ঘুরিয়ে নিতে থাকে টুশকিকে। পানির নিচে দিয়ে যেতে চায় মাঝেমাঝেই–নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতেই খোঁচা দিয়ে টুশকিকে উপরে তুলে আনতে হয় তখন নিঃশ্বাস নেয়ার জন্যে। প্রচণ্ড ঢেউ বৃষ্টির ঝাঁপটা আর বাতাসের শেশো শব্দের মাঝে বকুল টুশকির পিঠে করে ছুটে যেতে থাকে। নদীর মাঝামাঝি পানির প্রচণ্ড স্রোত, বকুল মাথা তুলে তাকাল, কাউকে দেখা যাচ্ছে কি না খোঁজার চেষ্টা করল কিন্তু কেউ নেই। বকুল টুশকির পিঠে থাবা দিয়ে আবার ছুটে চলল সামনে, গোল হয়ে ঘুরে এল একবার, এখনও কাউকে দেখা যাচ্ছে না। বকুল মাথা তুলে চিৎকার করে একবার ডাকল, “কোথায়? কোথায় কে?”
সাথে সাথে মানুষের ক্ষীণ একটা চিৎকার শুনতে পেল, “এই যে এখানে।”
বকুল গলার আওয়াজের শব্দ লক্ষ্য করে টুশকিকে সেদিকে নিয়ে যেতে থাকে, কিছুক্ষণের মাঝেই সে মানুষ দুজনকে দেখতে পায়, নদীর প্রবল স্রোতে ভেসে যাচ্ছে দুজনে। হুটোপুটি করে তার মাঝে ভেসে থাকার চেষ্টা করছে কোনো রকমে, বকুল চিৎকার বলল, “আসছি আমি।”
টুশকি প্রথমে অপরিচিত মানুষ দুজনের কাছে যেতে রাজি হচ্ছিল না, বকুলকে বারকতক চেষ্টা করে তাকে রাজি করাতে হল। টুশকি কাছে যেতেই একজন ঝাঁপিয়ে পড়ে টুশকিকে ধরতেই টুশকি গা-ঝাড়া দিয়ে পানির নিচে ডুবে গেল। বকুল টুশকিকে ছাড়ল না,পা দিয়ে পেটে খোঁচা দিয়ে আবার তুলে আনল উপরে। বকুল আবার টুশকিকে কাছে নিয়ে হাত বাড়িয়ে বলল, “আমার হাত ধরেন।”
মানুষটা তার হাত জাপটে ধরল। বকুল মানুষটাকে কাছে টেনে এনে চিৎকার করে বলল, “টুশকির গায়ে হাত দেবেন না–আপনাকে চেনে না, ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবে।”
বৃষ্টি আর ঝড়ের শব্দে বকুলের কথা শুনতে পেল না মানুষটা, চিৎকার করে বলল, “কী?”
বকুল আবার বলল চিৎকার করে, মানুষটা এবারে কথা বুঝতে পারল। বকুল এবারে দ্বিতীয় মানুষটার কাছে নিয়ে গেল টুশকিকে। পানিতে ভেসে যাবে না, কেউ-একজন এসেছে সাহায্য করতে এই ব্যাপারটাতেই মানুষ দুজন খুব সাহস ফিরে পেয়েছে। বকুল টুশকিকে নিয়ে কাছে গেলে বিদেশী সাহেবটা সাবধানে বকুলের শরীরে ঝাঁপটে ধরল। বকুল তখন টুশকিকে ইঙ্গিত দিতেই সেটা তীরের দিকে সাঁতার কাটতে থাকে।
দুষ্টুমি করার জন্যে কি না কে জানে মাঝেমাঝেই টুশকি পানির গভীরে চলে যাচ্ছিল, যখন ওদের নিঃশ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম হচ্ছিল তখন আবার ভুস করে পানির উপরে উঠে আসছিল। স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কেটে তীরে আসতে আসতে দীর্ঘ সময় লেগে গেল, ততক্ষণে ঝড়ের বেগ একটু কমেছে, নদীর তীরে বেশকিছু মানুষ জমা হয়েছে ব্যাপারটি দেখার জন্যে। হিজল গাছের নিচে এসে টুশকি পানিতে ডুবে গেল, মানুষ দুজন তখন বকুলকে ছেড়ে দিয়ে কোনমতে উপরে উঠে আসার চেষ্টা করে। নদীতীরে যারা দাঁড়িয়ে ছিল তারা এসে মানুষ দুজনকে টেনে উপরে তুলে নিয়ে আসে। নদীতীরে একটা হৈচৈ শুরু হয়ে যায়, তাদের দুজনকে কোথায় নেবে কী করবে সেটা নিয়ে বাগ্বিতণ্ডা হতে থাকে। বকুল সেটা দেখার জন্যে আর দাঁড়াল না। একটু আগে সে যেটা করেছে তার জন্যে বাড়িতে বাবা-মার কাছে তার যে কপালে অনেক দুঃখ আছে সেটা বুঝতে বকুলের খুব দেরি হল না।
ঝড়টা যেরকম হঠাৎ করে এসেছে ঠিক সেরকম হঠাৎ করে থেমে গেল। সারা গ্রামে অবিশ্যি ভাঙা গাছ, পাতা উড়ে আসা ছাউনি, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা জিনিসপত্র পড়ে রইল। এই ভয়ংকর ঝড়ের মাঝে বকুল কী করেছে যখন সবে মাত্র সেই খবরটা বের হতে শুরু করেছে এবং বাবা-মা বড়চাচা বকুলকে বকাবকি করার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছেন তখন উত্তেজিত শরিফ এসে খবর দিল একজন বিদেশি সাহেব আর একজল্ল দেশি সাহেব বকুলের সাথে দেখা করতে চায়।
বকুল সাথে সাথে বুঝতে পারল মানুষগুলো কে এবং কেন এসেছে। সে বাইরে বের হয়ে এল, মানুষ দুজনকে ঘিরে গ্রামের অনেক মানুষ জড়ো হয়েছে, ছোট ছোট বাচ্চারা বেশ অবাক হয়ে বিদেশি সাহেবটাকে দেখছে, তারা হাফপ্যান্ট পরা এরকম বিচিত্র গোলাপি রঙের মানুষ আগে কখনো দেখেনি।
দেশি সাহেবটা এগিয়ে এসে বলল, “এই মেয়ে–তু–তুই বুঝি শুশুক নিয়ে আমাদের কাছে গিয়েছিলি?”
লোকটার কথার ভঙ্গি শুনে বকুলের মাথার মাঝে একটা ছোটখাটো বিস্ফোরণ হল। ইচ্ছে হল লাফিয়ে গিয়ে মানুষটার টুটি চেপে ধরে। বিদেশি সাহেবটা ইংরেজিতে বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ, এই মেয়েটাই। সাহসী মেয়ে। চালাক মেয়ে।”
দেশি সাহেবটা পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা ভেজা মানিব্যাগ বের করে, সেখানে থেকে ভেজা দুটি পাঁচশো টাকার নোট বের করে বকুলের দিকে এগিয়ে দিল। বকুলের ইচ্ছে করল খামচি দিয়ে মানুষটার মুখ রক্তাক্ত করে দেয়, কিন্তু সে কিছুই করল না। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
মানুষটি বলল, “নে।”
বকুল চারিদিকে তাকাল, অনেক মানুষ দাঁড়িয়ে আছে তাদের ঘিরে। বামদিকে মণ্ডলবাড়ির সাদাসিধে কামলা বদিও আছে, চোখেমুখে সরল একটা বিস্ময় নিয়ে দেখছে। বকুল হাত বাড়িয়ে, টাকাটা নিয়ে বদির দিকে এগিয়ে দিতেই বদি এগিয়ে এসে লোভীর মতো ছোঁ মেরে নোট দুটি নিয়ে নিল। দেশি সাহেব আহত গলায় বলল, “এটা বিশ টাকার নোট না, পাঁচশ টাকার নোট!”
বকুল বদির দিকে তাকিয়ে বলল, “বদি ভাই, এগুলো পাঁচশো টাকার নোট।”