বকুল তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে নদীর দিকে তাকিয়ে স্পিডবোটটা দেখার চেষ্টা করল, ঝড় বৃষ্টি, ফুলে ওঠা ঢেউয়ের জন্যে কিছুটা দেখা গেল না। আকাশ কালো হয়ে আছে। বৃষ্টির ছাটে চোখ খুলে রাখা যায় না। আবার আকাশ চিরে একটা বিদ্যুতের ঝলকানি নিচে নেমে এল আর সেই আলোতে বকুল দেখতে পেল নদীর মাঝামাঝি স্পিডবোটটা প্রচণ্ড ঢেউয়ে ওলটপালট করছে। ভিতর মানুষ আছে কি নেই সেটাও বোঝা যাচ্ছে না।
স্পিডবোটের ইঞ্জিনটা আবার একবার শব্দ করল, তারপর আবার ক্ষীণ হয়ে প্রায় থেমে গেল। একটু পরে আবার একটু গর্জন করে উঠল, বিদ্যুতের আলোতে আবার দেখতে পেল স্পিডবোটটা বিশাল ঢেউয়ের উপর অসহায়ভাবে নাচানাচি করছে।
“স্পিডবোটটা নিশ্চয়ই ডুবে যাবে–” বকুল ফিসফিস করে বলল, “হে খোদা, তুমি মানুষগুলোকে বাঁচাও!”
প্রচণ্ড ঝড়ে নিজেকে কোনমতে স্থির করে রেখে বকুল তীক্ষ্ণচোখে নদীর দিকে তাকিয়ে থাকে। গ্রামের বিভিন্ন বাড়ি থেকে হৈচৈ শোনা যাচ্ছে, বড় ঝড় হলে আজান দেওয়া শুরু হয়, বকুল কান পেতে শুনতে পেল মণ্ডলবাড়ি থেকে আজানের শব্দ ভেসে আসছে। ঝড়ের প্রচণ্ড শব্দ, বিদ্যুৎ, বজ্রপাত, বৃষ্টির মাঝে, মানুষের আর্তচিৎকারের মাঝে আজান শুনলে কেমন জানি আতঙ্কের মতো হয়। বকুল সেই ভয়ংকর পরিবেশে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে নদীর দিকে তাকিয়ে রইল, আরেকবার বিজলি চমকানোর সাথে সাথে বকুল দেখল স্পিডবোটটি নেই।
বকুল নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে থাকে, প্রচণ্ড ঝড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে তার রীতিমতো যুদ্ধ করতে হচ্ছে, বৃষ্টির ছাঁটে চোখ খুলে রাখা যাচ্ছে না তবু সে চোখ খুলে তাকিয়ে রইল পরের বিদ্যুঝলকের জন্যে। সত্যি সত্যি আরেকবার বিদ্যুৎ চমকে উঠলে বকুল দেখল স্পিডবোটটি নেই, নদীর প্রবল ঢেউয়ে দুজন মানুষের মাথা ভাসছে, হাত নড়ছে কিছু-একটা ধরে ভেসে থাকার চেষ্টায়। স্রোতের টানে মানুষগুলো ভেসে যাচ্ছে দক্ষিণে। শুধু তাই নয়, বকুলের মনে হল ঝড়ের শব্দ, বৃষ্টির শব্দ আর বাতাসের শব্দ ছাড়িয়ে সে শুনতে পেল মানুষের আর্তচিৎকার।
ডুবে যাবে মানুষগুলো-বকুলের মাথায় বিদ্যুঝলকের মতো খেলে গেল, কিছু একটা করা না গেলে মানুষ দুটি ভেসে যাবে, কেউ আর তাদের বাঁচাতে পারবে না। এই প্রচণ্ড ঝড়ে মানুষ দুজন কিছুতেই সাঁতরে তীরে আসতে পারবে না, ঢেউয়ের ধাক্কায় শেষ হয়ে যাবে দুজনে। কিছু-একটা করতে হবে বকুলের।
গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে লাগল বকুল, কিন্তু ঝড়ের প্রচণ্ড শব্দে কেউ তার চিৎকার শুনতে পারল না। শুনতে পেলেও কিছু লাভ হত না, এই প্রচণ্ড ঝড়ে কে যাবে তাদের উদ্ধার করতে?
“টুশকি!” হঠাৎ করে বকুলের টুশকির কথা মনে পড়ল। শুধুমাত্র টুশকিই পারবে তাদের বাঁচাতে–এই প্রচণ্ড ঝড়ে তাদের কাছে সাঁতরে যেতে পারবে শুধু টুশকি। বকুল ছুটে গেল হিজল গাছটার কাছে, ঝড়ে ডালগুলো নড়ছে মনে হচ্ছে, যে-কোন মুহূর্তে বুঝি হুমমুড় করে ভেঙে আছড়ে পড়বে নদীর কালো পানিতে। বৃষ্টিতে ভিজে পিছল হয়ে আছে গাছটি, সাবধানে নিচের ডালে উঠে দাঁড়াল বকুল, বাতাসের ঝাঁপটায় সে পড়ে যেতে চাইছে নিচে, তার মাঝে শক্ত করে ধরে রাখল মোটা ডালটা। চাবুকের মতো ছুটে আসছে সরু ডালগুলো, শরীর নিশ্চয় ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে তার–বুঝতে পারছে না এখন।
গাছের ডালের নিচে নেমে এসে ডালটাকে ঝাঁকাতে লাগল গায়ের জোরে, পানিতে ডালগুলো শব্দ করতে লাগল। টুশকিকে ডাকতে হলে সে এখানে এসে ডালগুলোকে ঝাঁকিয়ে শব্দ করে। কখনোই সমস্যা হয়নি আগে, প্রত্যেকবারই ডেকে এসেছে টুশকিকে। কিন্তু এখন এই ঝড়ের প্রচণ্ড উথালপাতাল শব্দে কি টুশকি শুনতে পাবে পানিতে ডাল ঝাঁপটানোর শব্দ? আসবে কি টুশকি?
হিজল গাছের ডালটিতে লাফিয়ে লাফিয়ে বকুল যখন প্রায় হাল ছেড়ে দিচ্ছিল ঠিক তখন হঠাৎ নদীর কালো পানির মাঝে থেকে ভুস করে টুশকি বের হয়ে এল।
“টুশকি!” বকুল চিৎকার করে বলল”টুশকি! এসেছ?”
টুশকি বকুলর কথা বুঝতে পারল কি না বোঝা গেল না, কিন্তু পানিতে ঘুরে এসে আবার ভুস করে ভেসে উঠে লাফিয়ে উপরে উঠে এল। ঝড়ের মাঝে বকুলের যেরকম আনন্দ হয়, টুশকিরও ঠিক সেরকম আনন্দ হয় বলে মনে হচ্ছে।
“টুশকি! আমি আসছি–”বলে বকুল নদীর ফুঁসে ওঠা কালো পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। অন্ধকার পানিতে ডুবে যাওয়া সাথে সাথে হঠাৎ করে ঝড়ের প্রবল গর্জন, বাতাসের শব্দ বৃষ্টির ছাঁট সবকিছু অদৃশ্য হয়ে একটা সুমসাম নীরবতা নেমে এল চারপাশে। পানির নিচে ডুবে থেকে আবার ডাকল বকুল”টুশকি!” মুখ থেকে বাতাসের বুদ্বুদ বের হয়ে এল তার কথার সাথে সাথে।
বকুল হঠাৎ তার নিচে টুশকির মসৃণ শরীরের স্পর্শ অনুভব করল, সাথে সাথে জাপটে ধরে পা দিয়ে পেটে একটা খোঁচা দিল টুশকিকে। টুশকি বকুলকে পিঠে নিয়ে ছুটে গিয়ে পানির উপরে লাফিয়ে উঠে আবার পানিতে আছড়ে পড়ল। টুশকি ভাবছে বকুল বুঝি তার সাথে খেলার জন্যে তাকে ডেকে এনেছে।
বকুল টুশকির গলা জড়িয়ে ধরে মাথার কাছে বারকয়েক থাবা দিল, চাপা গলায় চিৎকার করে বলল, “সামনে, সামনে চল। মানুষ ডুবে যাচ্ছে।”
টুশকি বকুলের কথা বুঝতে পারল কি না বোঝা গেল না কিন্তু হঠাৎ গতি পালটে নদীর গভীরের দিকে রওনা দিল। প্রচণ্ড ঝড়ে মনে হচ্ছে সব ধ্বংস হয়ে যাবে, পানির ঢেউয়ের আঘাতে তলিয়ে নিচ্ছে সবকিছু, তার মাঝে তীরের মতো ছুটে যেতে থাকল টুশকি, তার গলা ধরে শক্ত করে ঝুলে রইল বকুল।