যে-গাছ নতুন চাঁদ ওঠার আগে একজন মানুষের জান নিয়ে নদীর পানিতে ধসে পড়বে সেই গাছের ধারেকাছে যে কেউ যাবে না তাতে অবাক হবার কী আছে? কাজেই পলাশপুর গ্রামের বিশাল হিজল গাছটা অর্ধেক ডাঙায় আর অর্ধেক নদীর পানির উপর বিস্তৃত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, একসময় যার ডালে ডালে ছোট ছোট বাচ্চারা লাফঝাঁপ দিত এখন সেটি জনশূন্যে নির্জন, সেখানে কেমন যেন চাপা ভয়-ধরানো থমথমে ভাব। গাছে ওঠা দূরে থাকুক তার নিচেও কেউ যায় না।
একেবারে কেউই কখনো হিজল গাছটার নিচে যায়নি সেটা অবিশ্যি পুরোপুরি সত্যি নয়, কাজীবাড়ির ছোট মেয়ে বকুলকে এক দুই বার সেই গাছের নিচে হাঁটাহাঁটি করতে দেখা গেছে।
বকুল কাজীবাড়ির মেজো ছেলের ছোট মেয়ে। তার বয়স বারো। তাই বড় দুই বোনের বিয়ে হয়ে গেছে এবং তারা সুখে সংসার করছে। তার বড় দুলাভাইয়ের সদরে মনোহারী দোকান রয়েছে, মেজো দুলাভাই ইউনিয়ন কাউন্সিলের মেম্বার। বকুলের ছোট ভাই শরিফ নেহায়েৎ শান্তশিষ্ট ছেলে, বড় হয়েও যে সে শান্তশিষ্ট থাকবে এবং একটা স্কুলের (কিংবা কে জানে হয়তো কলেজের) মাস্টার হয়ে যাবে সেটা নিয়ে কারও কোন সন্দেহ নেই। তবে বকুলকে নিয়ে কী হবে সে-ব্যাপারে শুধু কাজীবাড়ির নয় পুরো পলাশপুর গ্রামের সব মানুষের মনে সন্দেহ রয়েছে। তার বয়স বারো, আর কয়েক বছরের মাঝেই এই গ্রামের নিয়মে তার বিয়ের বয়স হয়ে যাবে কিন্তু বকুলের কথাবার্তা আচার আচরণে তার কোন ছাপ নেই। তার সমবয়সী কোন মেয়ের সাথে তার ভাব নেই, সে ঘোরাফেরা করে ছেলেদের সাথে। তার মতো ফুটবল কেউ খেলতে পারে না, মারবেল খেলে সে এলাকার সবাইকে ফতুর করে দিয়েছে। চোখের পলকে সে যে-কোনো গাছের মগডালে উঠে পড়তে পারে, বর্ষাকালে বানের পানিতে যখন চন্দ্রা নদী ফুলেফেঁপে ওঠে তখন সে আড়াআড়িভাবে সাঁতরে নদী পার হয়ে যায়। পলাশপুর গ্রামে কোন হাইস্কুল নেই বলে বড় বড় সব মেয়ের পড়া বন্ধ হয়ে গেছে, কিন্তু বকুল একরকম জোর করে পাঁচ মাইল দূরে হাইস্কুলে পড়তে যায়। ভোরবেলা সে পলাশপুর গ্রামের বাচ্চাকাচ্চাদের নিয়ে গ্রামের সড়ক ধরে হেঁটে হেঁটে স্কুলে যায়, স্কুলে যাবার এবং সেখান থেকে ফেরার সময় সড়কের দুই পাশের গাছপাছালি, পুকুর, খাল, বিল সবকিছু চষে বেড়ায়।
বকুলের সমবয়সী মেয়েরা, যারা কয়েক বছরের মাঝে বিয়ে করে ঘর-সংসার করার জন্যে রান্নাবান্না আর ঘর-সংসারের কাজকর্ম শিখছে তারা বকুলের কাজকর্মের কথা শুনে একেবারের হাল ছেড়ে দেবার ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেও ভিতরে ভিতরে সবসময় কেমন যেন হিংসা অনুভব করেছে।
বকুলকে যারা পছন্দ করে তাদের সংখ্যা খুব কম নয়। তাদের বেশির ভাগের বয়স পাঁচ থেকে দশের মাঝে। তারা একেবারে বাধ্য সৈনিকের মতো বকুলের পিছনে পিছনে ঘোরে, বকুল তার এই অনুগত ভক্ত ছেলেমেয়েদেরকে মারতে হয় তার কায়দা-কানুন তাদের বাড়ির পিছলছল। তার ছিপছি কেমন করে গাছে চড়তে হয় শেখায়, নদী সাঁতরে পার হওয়া শেখায়, পাখির বাচ্চা ধরে এনে দেয়, গুলতি তৈরি করে দেয়, ফুটবল খেলায় কেমন করে ল্যাং মারতে হয় আবার অন্য কেউ ল্যাং মারার চেষ্টা করলে কীভাবে লাফিয়ে পাশ কাটাতে হয় তার কায়দা-কানুন হাতে-কলমে বুঝিয়ে দেয়।
এই বকুল ভরদুপুরবেলা তাদের বাড়ির পিছনের পেয়ারা গাছের মগডালে থেকে একটা উঁশা পেয়ারা ছিঁড়ে নিচে নেমে আসছিল। তার ছিপছিপে শরীরে প্রায় কাঠবেড়ালির মতো গাছ বেয়ে ওঠা এবং নামা হিংসার চোখে দেখতে দেখতে পাশের বাড়ির সিরাজ একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “মেয়েছেলেদের গাছে ওঠা ঠিক না।”
বকুল নেমে গাছের মাঝামাঝি মসৃণ একটা ডালে পা ঝুলিয়ে বসে পেয়ারায় একটা বড় কামড় দিয়ে বলল, “মেয়ে আবার ছেলে হয় কেমন করে? আর কী হয় মেয়েরা গাছে উঠলে?”
সিরাজ গম্ভীর হয়ে বলল, “দোষ নয়। মেয়েছেলেদের কাজ হচ্ছে ঘর সংসারের কাজ।”
বকুল গাছের ডালে বসে থেকে পিচিক করে নিচে থুতু ফেলে বলল, “তোকে বলেছে! মেয়েরা আজকাল পকেটমার থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত সবকিছু হয় তুই জানিস?”
মেয়েরা প্রধানমন্ত্রী হয় শুনে সিরাজ বেশি অবাক হল না, কিন্তু পকেটমার হয় শুনে সে চোখ বড় বড় করে বলল, “সত্যি? মেয়েরা পকেটমারও হয়?”
বকুল তার মাথার এলোমেলো চুল ঝাঁকিয়ে বলল, “খালি পকেটমার? আজকাল মেয়ে-ডাকাত পর্যন্ত হয়! জরিনা ডাকাতের নাম শুনিসনি?”
সিরাজ নামটা শোনেনি, কিন্তু ছেলে হয়ে মেয়েদের এত বড় বীরত্বের কাহিনীটা সে এত সহজে মেনে নেবার পাত্র নয়, মাথা নেড়ে বলল, “কিন্তু সাহসের কাজ বেশি করে ছেলেরা!”
বকুল তার গাছের উপর থেকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বলল, “কচু! ছেলেরা যখন একটা সাহসের কাজ করে মেয়েরা তখন করে একশোটা!”
“কে বলছে?”
“বলবে আবার কে? সবাই জানে। পৃথিবীর যত মানুষ আছে সবার জন্ম হয়েছে মায়ের পেট থেকে। বাচ্চা জন্ম দেওয়া কত বড় সাহসের কাজ তুই জানিস? আছে কোন ব্যাটা ছেলে যে বাচ্চা জন্ম দিয়েছে? আছে?”
সিরাজ খানিকটা বিভ্রান্ত হয়ে বলল, “কিন্তু—”
“কিন্তু আবার কী? জানা কথা মেয়েদের সাহস বেশি, ছেলেদের কম। জমিলা বুড়ি হচ্ছে মেয়ে আর তাকে দেখে সব ছেলে কাপড়চোপড়ে–হি হি হি …” বকুল কথা শেষ না করে খিলখিল করে হাসতে শুরু করল।