বকুল চোখে বাইনোকুলার লাগিয়ে আবার নদীর মাঝে তাকাল, নৌকায় মানুষ দাঁড় টানছে, একজন মালবোঝাই একটা নৌকাকে লগি দিয়ে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। বকুল মানুষটার মুখের দিকে তাকাল, বুড়োমতো একজন মানুষ মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, শরীরটা পাথরের মতো শক্ত। মানুষটা লগি ঠেলতে ঠেলতে দাঁড়িয়ে গেল তারপর আকাশের দিকে তাকাল, তারপর ঘুর পিছনে হাল-ধরে থাকা মানুষটাকে কিছু-একটা বলল, তখন সেও আকাশের দিকে তাকাল। দুজনেই আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। বকুল বাইনোকুলারটি নামিয়ে রেখে আকাশের দিকে তাকাল, এক কোণায় একটা কালো মেঘ। বকুল মেঘটার দিকে ভালো করে তাকাল, এটার নিশানা ভালো নয়। মনে হচ্ছে কিছুক্ষণের মাঝেই একটা বড় ঝড় আসবে। বকুল আকাশের মেঘটার দিকে তাকিয়ে রইল, নিরীহ ছোট একটা মেঘ, কিন্তু কিছুক্ষণের মাঝেই নিশ্চয়ই সমস্ত আকাশ ছেয়ে যাবে। নদীতে নৌকাগুলোর মাঝে একটা ব্যস্ততার চিহ্ন দেখা যাচ্ছে, সবগুলোই ঝড় শুরু হওয়ার আগে মনে হয় তীরে চলে আসতে চাইছে। বিদেশি সাহেবকে নিয়ে যে স্পিডবোটটা ছিল সেটাকে এখন দেখা যাচ্ছে না, চলে গিয়েছে কি না কে জানে!
বকুল হিজল গাছটা থেকে নেমে এল। ঝড় শুরু হলে মানুষজন খুব আতঙ্কিত হয়ে যায়, কিন্তু ঠিক কী কারণ জানা নেই ঝড় দেখতে বকুলের অসম্ভব ভালো লাগে। যখন আকাশ কালো করে মেঘ হয়ে সেটা জীবন্ত প্রাণীর মতো আকাশে পাক খেতে থাকে–বিজলি চমকে চমকে উঠে প্রচণ্ড শব্দে বজ্রপাত হয়, প্রথমে দমকা হাওয়া তারপর প্রচণ্ড বাতাসে চারদিক থরথর করে কাঁপতে থাকে তখন বকুলের ইচ্ছে করে দুই হাত উপরে তুলে আনন্দে চিৎকার করতে করতে ছুটে বেড়ায়।
বকুল আবার আকাশের দিকে তাকাল, ছোট মেঘটা দেখতে দেখতে অনেকখানি বড় হয়ে গেছে, আকাশের একটা অংশ এর মাঝে অনেকখানি ঢেকে ফেলেছে। মেঘের মাঝখানে বিদ্যুতের ঝলকানি শুরু হয়ে গেছে। বকুল হিজল গাছ থেকে নেমে এল, বায়নোকুলারটা বাড়িতে রেখে আসতে হবে, ঝড়বৃষ্টিতে ভিজে গেলে এত সুন্দর জিনিসটা নষ্ট হয়ে যাবে। একবার ঝড় শুরু হয়ে গেলে মা বাড়ি থেকে বের হতে দেবে না, তাই আগে থেকেই বের হয়ে যেতে হবে। ঝড়ের মাঝে ছুটে বেড়াতে কী মজাই-না লাগে!
বকুল বাড়িতে বাইনোকুলার রেখে আবার যখন নদীর তীরে এসে হাজির হল তখন আকাশের অর্ধেক মেঘে ঢেকে গেছে, একটু আগে দিনটা ছিল আলো ঝলমল, এখন কেমন যেন অন্ধকার নেমে আসতে শুরু করেছে। চারিদিকে থমথমে একটা ভাব, এতটুকু বাতাস নেই। নদীর পানিতে কেমন যেন কালচে একটা রং চলে এসেছে। ছোট ছোট ঢেউ এসে তীরে আঘাত করছে। বকুল নদীর তীরে দাঁড়িয়ে থেকে দেখে, একটু আগেও কতকগুলো নৌকা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল, এখন চারদিক ফঁকা। আকাশে কিছু পাখি উড়ে উড়ে যাচ্ছে। মনে হয় পাখিগুলো মানুষ থেকেও আগে বুঝতে পারে কিছু-একটা হতে যাচ্ছে।
বকুল নদীর তীরে হাঁটতে থাকে, অন্যদিন হলে আরও কিছু বাচ্চাকাচ্চা জুটে যেত কিন্তু আজকে কেন জানি কেউ নেই। বকুল আবার আকাশের দিকে তাকাল, মেঘটা এখন পুরো আকাশকে ঢেকে ফেলেছে, আর কী ঘন কালো মেঘ, মনে হয় যেন কুচকুচে কালো ধোঁয়া। মেঘটা থেমে নেই, জীবন্ত প্রাণীর মতো নড়ছে, ঘুরপাক খাচ্ছে, এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় সরে যাচ্ছে। মেঘের ভিতর থেকে মাঝে মাঝে বিদ্যুতের ঝলকানি উঁকি দিচ্ছে, কেমন যেন একটা ভয় ভয় ভাব। বকুলের ভিতরে কেমন জানি একধরনের উত্তেজনার ভাব হয়–ভয়ের একটা ব্যাপার তার কেন এরকম আনন্দ আর উত্তেজনা হয় কে জানে!
নদীর পানিতে ঢেউটা আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে, কালো পানিতে একটা থমথমে ভাব, হঠাৎ হঠাৎ এসে তীরে আঘাত করছে। বকুল হিজল গাছটার নিচে গিয়ে দাঁড়াল এবং হঠাৎ করে বাতাসের একটা ঝাঁপটা অনুভব করল। ইতস্তত দমকা হাওয়া শুকনো পাতা ধুলোবালি খড়কুটো উড়তে থাকে। পশুপাখির চিৎকার শোনো যায়–চারিদিকে একটা ছুটোছুটি এবং তার মাঝে হঠাৎ কড়াৎ করে খুব কাছে যেন বাজ পড়ল। সাথে বিদ্যুতের ঝলকানিতে চারদিক আলো হয়ে ওঠে। দমকা বাতাসের বেগ বাড়ছে, শোঁ শোঁ আওয়াজ হতে থাকে এবং হঠাৎ আবার বিদ্যুৎ ঝলকানির সাথে সাথে প্রচণ্ড শব্দ করে খুব কাছাকাছি কোথাও আরও একটা বজ্রপাত হল। ফোঁটা ফোঁটা করে বৃষ্টি পড়তে শুরু করল, প্রথমে ছাড়াছাড়াভাবে একটু পরে একটানা। বৃষ্টির ঝাঁপটায় বকুল এক নিমিষে ভিজে চুপসে গেল। কী ভালোই না লাগে তার বৃষ্টিতে ভিজতে!
বাতাসের বেগ বাড়ছে তার সাথে বৃষ্টি। এমনিতে বৃষ্টির ফোঁটার মাঝে কোমল আদর করার একটা ভাব আছে কিন্তু ঝড়ের সময় বৃষ্টির ফোঁটাগুলো হয় রাগী আর তেজি। শরীরের মাঝে এসে বেঁধে তীরের মতো। বকুল বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে নদীর তীরে হাঁটতে থাকে, বাতাস মনে হয় তাকে উড়িয়ে নেবে কিন্তু সে পরোয়া করে না। দুই হাত উপরের দিকে তুলে চিৎকার করে বলে, “জোরে! আরও জোরে!”
আরও জোরে ঝড় আসে, বিদ্যুতের ঝলকানির সাথে সাথে প্রচণ্ড শব্দ করে বজ্রপাত হচ্ছে, আকাশ চিরে আলোর ঝলকানি নেমে আসছে নিচে। নদীর কালো পানি প্রচণ্ড আক্রাশে যেন ফুঁসে উঠছে, ভেঙেচুরে যেন ধ্বংস করে দেবে চারিদিক।
বকুল নদীর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ঝড়ের শব্দ শুনতে থাকে, হঠাৎ করে সে ঝড়ের শব্দ ছাপিয়ে আরও একটা শব্দ শুনল–স্পিডবোটের ইঞ্জিনের শব্দ। শব্দটি একটানা নয়, ছাড়াছাড়া–মনে হচ্ছে নদীর ঢেউ আর ঝড়ের সাথে যুদ্ধ করতে করতে স্পিডবোটটা এগিয়ে যাবার চেষ্টা করছে। এই প্রচণ্ড ঝড়ে পুরোপুরি মাথা খারাপ না হলে কেউ নদীতে স্পিডবোট চালানোর চেষ্টা করে? বিদেশি সাহেবটা নিশ্চয়ই এই দেশের কালবৈশাখীর কথা শোনেনি! বুঝতেই পারেনি এত তাড়াতাড়ি এত বড় ঝড় শুরু হতে পারে।