ফ্লোরিডায় আমি কি দেখেছি তুমি চিন্তাও করতে পারবে না! একটা জায়গা আছে সেটার নাম হচ্ছে সী-ওয়ার্ল্ড। সেখানে পানির মাঝে থাকে ডলফিন ঠিক টুশকির মতো। সেই ডলফিন যে কী মজার খেলা দেখায় চিন্তা করতে পারবে না। আমি আব্বুকে বলেছি দেশে এরকম একটা পার্ক খুলতে সেখানে টুশকি খেলা দেখাবে। কী মজা হবে না?
আব্বু আমাকে এখনই কেনেডি স্পেস সেন্টারে নিয়ে যাবে বলে চিঠি আর বড় করতে পারলাম না। দেশে ফিরে আসার জন্যে জীবন বের হয়ে যাচ্ছে।
ইতি প্রাণের বন্ধু নীলা।
পুনঃ আর কয়েকদিনের মাঝেই আমরা দেশে চলে আসব। হা হা হা।
০৭. বকুল হিজল গাছটার মাঝামাঝি
বকুল হিজল গাছটার মাঝামাঝি পা ঝুলিয়ে বসে বাইনোকুলার দিয়ে দেখছে। বাইনোকুলারের মতো মজার জিনিস পৃথিবীতে কি আর একটাও আছে? একজনকে এত কাছে থেকে দেখা যায় মনে হয় হাত দিয়ে ছোঁয়াও যাবে অথচ সেই মানুষটা জানেও না যে তাকে কেউ দেখছে! বকুল বেশ অনেকক্ষণ থেকে বাইনোকুলারে স্পিডবোটটাতে বসে থাকা দুজন মানুষকে দেখছে। একজন বিদেশি, এত বড় মানুষ অথচ একটা হাফপ্যান্ট পরে বসে আছে, অন্যজন দেশি মানুষ। বিশাল গর্জন করে পানি কেটে স্পিডবোটটা এসেছে, এখন ইঞ্জিনটা বন্ধ করে দিয়ে সেটা পানির মাঝে দাঁড়িয়ে আছে। বাইনোকুলারে স্পষ্ট দেখা যায় মানুষগুলো কথা বলছে কিন্তু সেই কথা শোনা যায় না। বাইনোকুলার দিয়ে যেরকম দূরের জিনিস দেখা যায় সেরকম দূরের মানুষের কথা শোনার এরকম কি কোনো যন্ত্র আছে?
মানুষ দুজন হাত দিয়ে পানির দিকে দেখল তারপর তাদের গ্রামের দিকে তাকাল, কিছু একটা যন্ত্রের মতো। জিনিস পানিতে ডুবিয়ে দিয়ে অন্য একটা যন্ত্রের মতো জিনিসের দিকে তাকিয়ে রইল। এই স্পিডবোটটা গত কয়েকদিন হল বেশ ঘনঘন আসছে এখানে, এসে নদীর মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে থেকে কী যেন করে। আগে বকুল বুঝতে পারত না কী করছে বাইনোকুলারটা পাওয়ার পর সে দেখতে পারে কী করছে কিন্তু এখনও কিছু বুঝতে পারছে না।
বাইনোকুলারটা তার জন্যে এনেছে নীলা। শুধু বাইনোকুলার না, জামাকাপড় জুতো, সোয়েটার, বই, ক্যালকুলেটর, ক্যামেরা কিছু বাকি রাখেনি। মনে হয় আস্ত একটা দোকান তুলে এনেছে। আরও অনেক জিনিস এনেছে যার নাম পর্যন্ত সে জানে না। পানির নিচে সাঁতার কাটার জন্যে একরকম চশমা, সাথে একটা ছোট নল যেন পানিতে ডুবে ডুবে নিঃশ্বাস নেওয়া যায়। ব্যাঙের পায়ের মতো বড় বড় পা, পায়ে লাগিয়ে সাঁতার কাটা ভারি সুবিধে। পাউডার, ক্রিম, লোশন, শ্যাম্পু, এনেছে প্রায় এক বাক্স। গ্রামের সব মেয়েকে দিয়েও মনে হচ্ছে শেষ হবে না। জামাকাপড়গুলো এত সুন্দর যে চোখ ফেরানো যায় না, কিন্তু মুশকিল হল যে সে এই কাপড়গুলি কোথায় পরবে বুঝতে পারছে না। ঈদের দিনে কিংবা কারও বিয়ে হলে পরা যায়। বকুলদের বাসায় যেদিন বেড়াতে যাবে সেইদিনও পরতে পারে। তবে ছেলেদের মতো প্যান্ট আর ঢলঢলে টি-শার্টগুলি সে মনে হয় কোনদিনও পরতে পারবে না, কোনো ছেলেকেই দিয়ে দিতে হবে। শহরের মেয়েরা মনে হয় শার্ট-প্যান্ট পরে ঘুরতে পারে, সে কীভাবে পারবে?
যেদিন নীলা এসেছিল সেদিন বকুল আর নীলা সারাদিন একসাথে কাটিয়েছে। সকালবেলা গল্পগুজব, দুপুরবেলা পানিতে ঝাঁপাঝাঁপিটুশকির সাথে খেলাধুলা, বিকেলে গ্রামে রাস্তায় রাস্তায় হেঁটে বেড়ানো। কথা বলে যেন আর শেষ হয় না। যে-কথাটি অনেকদিন থেকে কাউকে বলবে বলবে করে নীলা কখনো কাউকে বলতে পারেনি সেগুলো বকুলকে বলেছে। দীর্ঘ সময় নিয়ে বকুলকে তার মার কথা বলেছে। বলতে বলতে ভেউভেউ করে কেঁদে ফেলেছে। বকুল তখন তাকে শক্ত করে ধরে রেখে নিজেও ভেউভেউ করে কেঁদেছে। দুইজন একজন আরেকজনকে ধরে কাঁদতে কাঁদতে গ্রামের মাঠের নির্জন রাস্তায় রাস্তায় হেঁটে বেড়িয়েছে। বকুল তার ওড়না দিয়ে নিজের চোখ মুছে নীলার চোখ মুছে দিয়েছে। সান্ত্বনার কথা বলেছে।
ইশতিয়াক সাহেব শমসেরকে নিয়ে গ্রামের মাতব্বরদের সাথে কথা বলেছেন। যে-গ্রামটির জন্যে তার মেয়েকে ফিরে পেয়েছেন সেই গ্রামের জন্যে কিছু-একটা করতে চান। আপাতত শুরু করবেন একটা স্কুল নিয়ে। স্কুলটা কোথায় হবে, জায়গাজমি কীভাবে জোগাড় করা হবে সেটা নিয়ে কথাবার্তা হয়েছে, গ্রামের ঘুরে ঘুরে দেখেছেন।
সন্ধ্যেবেলা নীলা তাদের রাজহাঁসের মতো লঞ্চটাতে করে চলে গেছে। কয়েকদিনের মাঝে বকুলকে নীলাদের বাসায় বেড়াতে যেতে হবে। বকুল একেবারে গ্রামের মেয়ে, গ্রামের পথঘাট নদীতে ঘুরে বেড়াতে তার কোনো সমস্যা হয় না, কিন্তু নীলাদের বাসায় গিয়ে সে কী করবে বুঝতে পারছে না। সে কখনো কোন বড়লোকদের বাসায় যায়নি, শুনেছে তাদের বাথরুমগুলোই নাকি তৈরি হয় সাদা পাথরের। বিছানা নাকি হয় নরম, ঘরে ঘরে থাকে এয়ারকন্ডিশন, গরমের সময় ঘরটা হয় নদীর পানির মতো ঠাণ্ডা, শীতের সময় হয় কুসুম-কুসুম গরম। বকুল অবিশ্যি নীলাদের বাসায় যাওয়া নিয়ে মোটেও চিন্তার মাঝে নেই, নীলা হচ্ছে তার প্রাণের বন্ধু আর জীবনের বন্ধু, যার অর্থ হচ্ছে দুজন মিলে একজন মানুষ। কাজেই নীলা তাকে সব শিখিয়ে দিতে পারবে–সেও যেরকম নীলাকে গ্রামের জিনিসপত্র শিখিয়েছে, সাঁতার শেখাচ্ছে।