“ঠিক আছে স্যার।”
শমসের ঠিক যেরকম নিঃশব্দে হাজির হয়েছিল ঠিক সেরকম নিঃশব্দে বের হয়ে গেল। কয়েক সেকেন্ড পরেই শক্তিশালী স্পিডবোটের গর্জন শোনা গেল, শহর থেকে ডক্টর আজমলকে এক ঘণ্টার মাঝে নিয়ে আসার রহস্যটা ইশতিয়াক সাহেবের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল হঠাৎ।
আধা ঘন্টার মাঝে সত্যি সত্যি ইলিশ মাছ হাজির হল, সেটা কেটেকুটে রান্না করতে করতে আরও আধাঘণ্টা, খাওয়া শেষ হতে হতে আরও আধাঘণ্টা। ইশতিয়াক সাহেব সবাইকে নিয়ে খেতে চাইছিলেন, কিন্তু বকুল এবং অন্য বাচ্চাগুলো কিছুতেই রাজি হল না।
ডক্টর আজমল নীলাকে পরীক্ষা করে খানিকক্ষণ শুয়ে বিশ্রাম নিতে বললেন, সে কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না, কিন্তু এরকম জোর করে শুইয়ে দেবার পর প্রায় সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পড়ল। তার দুর্বল শরীর কি পরিমাণ ক্লান্ত হয়েছিল সে নিজেও জানত না।
বিকেলবেলা বকুল এল একটা ছোট মোরগের বাচ্চা হাতে-নীলার জন্যে এই মোরগের বাচ্চাটি সদকা দেওয়া হবে। ইশতিয়াক সাহেব মোরগের বাচ্চাটির দাম দেওয়ার চেষ্টা করলেন কিন্তু বকুল সজোরে মাথা নেড়ে বলল সাজ্জাদ জানিয়েছে যে নিজেদের মানুষেরা এর দাম দিয়ে দিলে সদকার কার্যক্ষমতা কমে যায়। ইশতিয়াক সাহেব সেটা শুনে আর দাম দেওয়ার চেষ্টা করলেন না, নীলাকে ডেকে দিয়ে একটু আড়ালে সরে গেলেন, দেখলেন অত্যন্ত গম্ভীরমুখে বকুল কিছু একটা বলছে, নীলা খুব মনোযোগ দিয়ে সেটা শুনছে।
খানিকক্ষণ পর নীলা এসে ইশতিয়াক সাহেবকে বলল, “আব্বু–আমি বকুলের সাথে যাই?”
“কোথায় যাবি?”
“এই তো গ্রামে।“
যে-মেয়েটি আজ সকালেও রুগ্ন হয়ে বিছানায় শুয়েছিল সেই মেয়েটি যদি এখন আরেকজনকে নিয়ে গ্রামে ঘুরে বেড়াতে চায় সেটি খুব সহজভাবে নেওয়া সম্ভব নয়। ডক্টর আজমল থাকলে তাকে জিজ্ঞেস করা যেত, কিন্তু তার হাসপাতালে ডিউটি ছিল বলে ঘণ্টাখানেক আগে চলে গিয়েছেন। নীলা আবার জিজ্ঞেস করল, “যাই বাবা?”
“ঠিক আছে, যা।”
সাথে সাথে নীলা গায়ে হালকা একটা সোয়েটার চাপিয়ে বকুলের সাথে রওনা দিল। দুজনে একটু দূরে সরে যেতেই ইশতিয়াক সাহেব চাপা গলায় ডাকলেন,
“শমসের—”
শমসের নিঃশব্দে এসে বলল, “জি স্যার?”
“ঐ যে দেখছ নীলা আর বকুল? তাদের দুজনকে চোখে-চোখে রাখবে। কিন্তু খুব সাবধান, তারা যেন বুঝতে না পারে।”
“ঠিক আছে স্যার।”
শমসের সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছিল তখন ইশতিয়াক সাহেব আবার ডাকলেন, “শমসের
“জি স্যার।”
“থাক দরকার নেই। আমার মেয়েটি কি বেঁচে যাবে কি না সেটা এখন নির্ভর করছে এই বাচ্চা মেয়েটার উপর।”
শমসের নিচু গলায় বলল, “আল্লাহ মেহেরবান।”
“ঐ মেয়েটাকে আমার বিশ্বাস করা উচিত। কী বল?”
“জি স্যার।”
০৫. বকুল আর নীলা পাশাপাশি
বকুল আর নীলা পাশাপাশি হেঁটে যাচ্ছে। বকুলের ডান হাতে শক্ত করে ধরে রাখা মোরগের বাচ্চা, সেটা মনে হয় তার অবস্থাটাকে বেশ মেনে নিয়েছে, কোনো রকম আপত্তি করছে না। নীলা জিজ্ঞেস করল, “কাকে দেবে এই মোরগটা।”
“খেলার মাকে।”
“খেলার মা? একজন মানুষের নাম খেলা?”
“আসল নাম খেলারানী। এখন বিয়ে করে ইন্ডিয়া চলে গেছে। হিন্দু মানুষ তো তাই গ্রামের মাতব্বরেরা খুব অত্যাচার করে।”
“হিন্দুদের মাতব্বরেরা অত্যাচার করে নাকি?”
“করে না আবার! খেলার মাকেও ইন্ডিয়া নিতে চেয়েছিল, সে যায় নাই। বলেছে এইটা আমার দেশ এইটা আমার মাটি। আমি যাব না। সে আর যায় নাই। মুরগির সদকাটা তারেই দেই, ভাল হবে।”
নীলা মাথা নাড়ল। বকুল মোরগের বাচ্চাটা হাতবদল করে বলল, “তা ছাড়া হিন্দু মানুষ তো, তাকে দিলে অন্য লাভ হবে।”
“কী লাভ?”
“সদকাটা দেওয়াটা মুসলমানদের নিয়ম, আল্লাহ্ খুশি হবে। হিন্দুদের যদি দেওয়া হয় তা হলে ভগবানও খুশি হবে। একই সাথে আল্লাহ্ আর ভগবান দুজনকেই খুশি করা!”
নীলা ভুরু কুঁচকে বলল, “আল্লাহ আর ভগবান একই না?”
বকুল ঘাড় নেড়ে বলল, “জানি না। হলে তো আরও ভালো।”
দুইজন কথা না বলে চুপচাপ কিছুক্ষণ হেঁটে যায়। বকুল একসময় বলল, “তোমাদের ঢাকা শহরে কত কী দেখার আছে। আমাদের এখানে তো দেখার মতো কিছুই নাই। তোমাকে যে কী দেখাই! দেখার মতো জিনিস হচ্ছে গিয়ে জমিলা বুড়ি, মতি পাগলা আর বিশু-চোরা।”
“এরা কারা?”
“জমিলা বুড়ি হচ্ছে ডাইনি বুড়ি।” নীলা চোখ কপালে তুলে বলল, “ডাইনি বুড়ি?”
“সবাই বলে। ছোট বাচ্চা দেখলে জাদু করে ব্যাঙে নাহলে ইঁদুর তৈরি করে বোঝার মাঝে ভরে ফেলে!”
“ধুর!”
“ছয়টা নাকি তার পোষা জ্বীন আছে। সবসময় সে জ্বীনদের সাথে কথা বলে।”
“যাও!”
বকুল দাঁত বের করে বলল, “দেখ নাই তো তাই বলছ যাও। দেখলে দাঁতে দাঁত লেগে যাবে। ফিট হয়ে ধড়াম করে পড়বে মাটিতে।”
“কচু!”
“আমার কথা বিশ্বাস হল না?”
বকুল মুখ শক্ত করে বলল, “চলো তা হলে জমিলা বুড়ির কাছে। যাবে?”
“চলো।”
“পরে কিন্তু আমাকে দোষ দিও না।”
নীলা মাথা নেড়ে বলল, “দেব না।”
বকুল নীলাকে নিয়ে জমিলা বুড়ির বাসায় যেতে যেতে বলল, “জমিলা বুড়িকে না দেখে চলো মতি পাগলাকে নাহয় বিশু চোরাকে দেখতে যাই।
“কেন?”
“ওদের দেখার মাঝে কোনো বিপদ নাই। মতি পাগলাকে সবসময় বেঁধে রাখে–কিছু করতে পারে না। আর বিশু-চোরা হচ্ছে বিখ্যাত চোর। চুরির যদি কোনো কম্পিটিশান থাকত তা হলে বিশু-চোরা গোল্ড মেডেল পেত!”