“আসতে হবে না বাবা, আমি নিজেই পারব।”
ইশতিয়াক সাহেব অবাক হয়ে দেখলেন দুর্বল শরীরে নীলা লঞ্চের সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে, তার সামনে পিছনে ছোট ছোট বাচ্চারা তাকে ধরে রেখেছে যেন পড়ে না যায়। নিচে কাদামাটি, তার কাছে ঘোলা পানি, সেখানে হাঁটতে হাঁটতে প্যারিস থেকে কেনা তার সাদা জুতো কাদায় মাখামাখি হয়ে যাচ্ছে, নিউইয়র্কের ম্যাসিতে এই ফ্রকটা কিনেছিলেন আড়াইশো ডলার দিয়ে, নদীর ঘোলা পানিতে ভিজে একাকার হবে এক্ষুনি! কিন্তু ইশতিয়াক সাহেব সেদিকে দেখছিলেন না, তিনি তাকিয়ে ছিলেন নীলার মুখের দিকে, কী অপূর্ব প্রাণশক্তিতে হঠাৎ করে সেটা জ্বলজ্বল করছে। নিঃশ্বাস বন্ধ করে সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তিনি নিচু গলায় ডাকলেন, “শমসের–”
সাথে সাথে সারেঙের ঘর থেকে মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ বের হয়ে এল, বলল, “স্যার, আমাকে ডেকেছেন?”
“হ্যাঁ। তুমি যাও, ডক্টর আজমলকে নিয়ে এসো। যেভাবে হোক। কতক্ষণ সময় লাগবে?”
“এক ঘণ্টা লেগে যাবে স্যার।”
“এক ঘণ্টার পারবে নিয়ে আসতে?”
“যদি ডাক্তার সাহেবকে খুঁজে আনতে না হয় তা হলে পারব স্যার।”
“ভেরি গুড! যাও। বলবে খুব জরুরি। খুব খুব জরুরি।”
বকুল পানিতে শুশুকটার গলা জড়িয়ে ভেসে আছে, তাকে ঘিরে আরও কিছু বাচ্চা হুটোপুটি করছে। ইশতিয়াক সাহেব লঞ্চের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছেন। বেশ কয়েকজন মিলে নীলার হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছে। ইশতিয়াক সাহেব বুকের মাঝে একধরনের কাঁপুনি অনুভব করতে থাকেন। ফুলের মতো কোমল তাঁর এই মেয়েটার যদি কিছু-একটা হয়? শুশুকের শক্তিশালী লেজের ঝাঁপটায় যদি সে আছড়ে পড়ে ডুবে যায় পানিতে, নদীর স্রোতে যদি ভেসে যায় খড়কুটোর মতো?
.
নীলা শীতে কাঁপছে ঠকঠক করে, কাঁপতে কাঁপতে সে মাছের টুকরোটা উঁচু করে ধরে রাখল আর শুশুকটা হঠাৎ পানির নিচ থেকে লাফিয়ে উঠে ওর হাত থেকে মাছটা নিয়ে আবার পানির নিচে অদৃশ্য হয়ে গেল। ডজনখানেক নানা বয়সের বাচ্চা হাততালি দিয়ে চিৎকার করে ওঠে, আর নীলা কাঁপতে কাঁপতেই খিলখিল করে হেসে উঠল আনন্দে।
লঞ্চের রেলিংটা শক্ত করে ধরে রেখে ইশতিয়াক সাহেব কাঁপা গলায় বললেন, “কী মনে হয় তোর আজমল? নীলা কি ডিপ্রেশান থেকে বের হয়ে আসছে?”
ডক্টর আজমল নিচু গলায় বললেন, “দেখ, ইশতিয়াক আমি চাই না তোর পরে আশাভঙ্গ হোক–তা-ই কিছু বলতে চাচ্ছি না। কিন্তু যদি নীলার মাঝে এই ভাবটা ধরে রাখা যায়–তা হলে মনে হয় একটা-কিছু হয়ে যাবে!”
“কতক্ষণ ধরে রাখতে হবে? কতক্ষণ?”
“বলা মুশকিল–যত বেশি সময় হয় ততই ভালো।”
“কিন্তু দেখছিস না শীতে কাঁপছে?”
“হ্যাঁ। এখন খানিকক্ষণের জন্যে উপরে নিয়ে আয়–শরীর মুছে আবার খানিকক্ষণ পরে না হয় খেলতে দিস! পানিতে ভিজেই যে খেলাতে হবে তা নয়–অন্য কোনোভাবে।”
“এই যে বকুল মেয়েটাকে দেখছিস নিশ্চয়ই জাদু জানে–নিশ্চয়ই জানে। কী বলিস তুই?’
ডক্টর আজমল হাসলেন, “হ্যাঁ, মাঝে মাঝে এরকম পাওয়া যায়। এক দুজন মানুষ–তাদের হাতের ছোঁয়ায় জাদু থাকে, চোখের দৃষ্টিতে জাদু–”
.
ইশতিয়াক সাহেব হঠাৎ আজমলের হাতটা চেপে ধরে প্রায় আর্তনাদ করে বললেন, “কী মনে হয় তোর? বাঁচবে আমার মেয়েটা? বাঁচবে?”
ডক্টর আজমল ইশতিয়াক সাহেবের কাঁধ স্পর্শ করে বললেন, “এত ব্যস্ত হচ্ছিস কেন? একটু ধৈর্য ধর। মনে হয় খোদা আমাদের কথা শুনেছেন।”
ইশতিকথাটি যেন তার জন্যে
নীলা শরীর মুছতে মুছতে বলল, “আব্বু, এমন খিদে লেগেছে যে মনে হচ্ছে আস্ত একটা ঘোড়া খেয়ে ফেলতে পারব।”
তুচ্ছ একটা কথা শুনে ইশতিয়াক সাহেবের চোখে পানি এসে গেল, শেষবার কবে মেয়েটি শখ করে কিছু খেতে চেয়েছে? সাবধানে চোখের পানি গোপন করে বললেন, “এখন তোর জন্যে ঘোড়া রান্না করবে কে?”
কথাটি যেন সাংঘাতিক হাসির কথা নীলা সেরকমভাবে হাসতে শুরু করল। ইশতিয়াক সাহেব মনে করতে পারলেন না শেষবার কবে তাকে হাসতে শুনেছেন। হাত দিয়ে মেয়েকে নিজের কাছে টেনে এনে বললেন”কী খাবি মা?”
“ইলিশ মাছের ভাজা দিয়ে ভাত খেতে ইচ্ছে করছে আব্বু। ঝাল করে কাঁচা মরিচ দিয়ে ভাজবে। কিন্তু–”
“কিন্তু কী?”
“লঞ্চের কিচেনে তো কোনো ইলিশ মাছ নেই।”
“কী হয়েছে ইলিশ মাছের?
“দেখলে না পুরো ইলিশ মাছটা খাইয়ে দিলাম টুশকিকে! যা পেটুক, তুমি বিশ্বাস করবে না! ইলিশ মাছ শেষ করে গলদা চিংড়ি রুইমাছ–”
ইশতিয়াক সাহেব যখন নীলাকে নিয়ে লঞ্চে করে বেড়াতে আসেন তখন সাথে নানারকম খাবারের আয়োজন থাকে। লঞ্চের নিচে রান্না করার ব্যবস্থা রয়েছে, কখনো খাওয়ার সমস্যা হয় না। আজ অবিশ্যি ভিন্ন ব্যাপার, কিচেনের যাবতীয় খাবার টুশকি নামের শুশুকটিকে খাইয়ে দেওয়া হয়েছে। ইশতিয়াক সাহেব দরজা দিয়ে গলা বের করে ডাকলেন, “শমসের–”
শমসের প্রায় সাথে সাথেই নিঃশব্দে হাজির হয়ে বলল, “আমাকে ডেকেছেন স্যার?”
“কিচেনের সব ইলিশ নাকি টুশকিকে খাইয়ে দেওয়া হয়েছে।”
“জি স্যার।”
“কতক্ষণে তুমি কিছু ইলিশ মাছ আনতে পারবে?”
শমসের খানিকক্ষণ তার নখের দিকে তাকিয়ে রইল যেন সেখানে কিছু একটা তথ্য লেখা রয়েছে, তারপর মুখ তুলে বলল, “বিশ মিনিট স্যার।”
“তোমাকে পুরো তিরিশ মিনিট সময় দিচ্ছি। যাও।”