কালাম বুক ফুলিয়ে বলল, “আমার গত বছর জন্ডিস হয়েছিল।”
জাহানারা ফিসফিস করে বলল, “আমার ম্যালেরিয়া।”
সিরাজ রতনকে দেখিয়ে হিহি করে হেসে বলল, “আর রতনের সারা বছর অসুখ থাকে। পেটের অসুখ নাহলে জ্বর নাহলে পাঁচড়া।
নীলা মাথা নেড়ে বলল, “আমার অসুখটা সেরকম অসুখ না।”
“তা হলে কীরকম অসুখ?”
“এটা আসলে–এটা-”নীলা ইতস্তত করে বলল, “এটা কোনদিন ভালো হবে না।”
সবাই কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। আজিজ বলল, “ডাক্তার দেখালেই তো অসুখ ভালো হয়।”
নীলা একটু হেসে বলল, “পৃথিবীর সব ডাক্তার দেখানো হয়েছে। এই অসুখটার কোন চিকিৎসা নেই।”
বাচ্চাদের দলটার মাঝে রতনকে সবচেয়ে বোকা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সে নিজের সুনামটা অক্ষুণ্ণ রাখার জন্যেই মনে হয় বলল, “তা হলে কি এখন তুমি মরে যাবে?”
বকুল সাথে সাথে রতনের কান ধরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “গাধার মতো কথা বলিস কেন?”
রতন নিজের কান বাঁচানোর চেষ্টা করতে করতে বলল, “চিকিৎসা না হলে মানুষ মরে যায় না? মনে নাই জব্বার চাচা–”
ইশতিয়াক সাহেব অসহায়ভাবে বাচ্চাদের আলোচনাটি শুনে যাচ্ছিলেন–এত খোলামেলাভাবে এরকম একটা বিষয় নিয়ে মনে হয় শুধু বাচ্চারাই আলোচনা করতে পারে। তিনি বিষয়টা পালটানোর চেষ্টা করতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই নীলা বলল, “আসলে ঠিকই বলেছে ও। আমি কয়েকদিনের মাঝে মরে যাব।”
সাজ্জাদ এই দলটার মাঝে সবচেয়ে ধার্মিক মানুষ, গত রোজায় সে ত্রিশটা রোজা রেখেছে, এর মাঝেই নিজে নিজে দশ পারা কোরান শরিফ পড়ে ফেলেছে। সে এগিয়ে এসে গম্ভীর গলায় বলল, “হায়াত-মউত আল্লাহর হাতে। কে কখন মারা যাবে কেউ বলতে পারে না।”
নীলা হাসিহাসি মুখে বলল, “আমি পারি।”
সাজ্জাদ মাথা নেড়ে বলল, “এইরকম করে কথা বলা ঠিক না। আল্লাহ নারাজ হবে। আল্লাহ্ চাইলে সব অসুখ ভালো হয়ে যায়।”
বকুল এবং অন্য সবাই জোরে জেরে মাথা নাড়তে থাকে। সাজ্জাদ উৎসাহ পেয়ে বলল, “যখন কঠিন অসুখ হয় তখন সদকা দিতে হয়।”
“সদকা?”
“হ্যাঁ, জানের সদকা দিতে হয় জান দিয়ে। মনে করো আল্লাহ্ ঠিক করেছে এই অসুখটা দিয়ে তোমার জান নেবে। তখন একটা মুরগি কিনে সেটাকে সদকা দিতে হয়। বলতে হয় আল্লাহ্ তুমি আমার জান না নিয়ে এই মুরগির জানটা নাও। আল্লাহ্ তখন মুরগির জান নিয়ে তোমার অসুখ ভালো করে দেবে।”
আজিজ জিজ্ঞেস করল, “মুরগি সদকা কি দেওয়া হয়েছে?”
নীলা মনে হল মুখের হাসি গোপন করে বলল, “না, দেওয়া হয়নি।”
“দেওয়া উচিত ছিল।”
বকুল বলল, “তুমি চিন্তা কোরো না, আমরা আজকেই তোমার জন্যে একটা মুরগি সদকা দেব।”
উপস্থিত অন্য সবাই মাথা নাড়ল এবং ঠিক তখন নদীর তীর থেকে কে–একজন চিৎকার কর উঠল, “শুশুক, শুশুক–”
সবাই লঞ্চের রেলিং ধরে নিচে তাকাল এবং অবাক হয়ে দেখল একটা বিশাল শুশুক লঞ্চটার কাছে ভেসে ভেসে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তীর থেকে একজন চিৎকার করে বলল, “মার, মার শালাকে!”
কেন শুশুককে মারতে হবে কেউ পরিষ্কার করে বুঝতে পারল না, কিন্তু সাথে সাথে লোকজন চিল পাথর হাতে নিতে শুরু করে, কে-একজন একটা কোচ নিয়ে আসার জন্যে ছুটতে থাকে।
বকুল নিচে তাকাল এবং সাথে সাথে শুশুকটাকে চিনতে পারল, লঞ্চের উপর থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে পিঠের আঘাতের চিহ্ন। সে চিৎকার করে বলল, “না–না–না, কেউ মেরো না।”
তার কথা শেষ হবার আগেই দুটি ঢিল ছুটে আসতে থাকে এবং কেউ কিছু বোঝার আগেই বুকল রেলিঙের উপরে উঠে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। নদীর পানিতে ঝপাং করে সে ডুবে যায়, কয়েক মুহূর্ত পরে সে যখন ভেসে উঠল সবাই অবাক হয়ে দেখল শুশুকটার গলা জড়িয়ে ধরে রেখেছে এবং শুশুকটা প্রাণের বন্ধুকে যেভাবে আদর করে সেভাবে বকুলকে তার মুখ দিয়ে আদর করে যাচ্ছে।
লঞ্চের উপর ইশতিয়াক সাহেব, নীলা, ডজনখানেক বাচ্চা, নদীর তীরে জনা দশেক মানুষ সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। সবার আগে কথা বলল নীলা, জিজ্ঞেস করল, “তু-তুমি এটাকে চেন?”
বকুল মুখের উপর থেকে ভিজে চুল সরিয়ে বলল, “হ্যাঁ, এটা আমার বন্ধু।”
“বন্ধু? বন্ধু! কী নাম?”
“টুশকি।”
“টুশকি! ইশ কী সুন্দর নাম! আমি টুশকিকে ছুঁতে পারি?”
রতন মাথা নেড়ে বলল, “কামড় দেবে। কামড় দিয়ে কপ করে মাথাটা খেয়ে ফেলবে।”
“ধুর গাধা! আজিজ ধমক দিয়ে বলল, “শুশুক তো মাছ, মাছ কি কামড় দেয়? বকুলাপ্পুকে কি কামড় দিচ্ছে?”
জাহানারা ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “বকুলাপ্পুকে বাঘও কামড় দেবে না। আমরা গেলে কপ করে খেয়ে ফেলবে।”
নীলা উপর থেকে আবার চিৎকার করে বলল, “আমি টুশকিকে ছোব।”
বকুল টুশকির গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে বলল, “নিচে পানিতে আসতে হবে।”
নীলা জ্বলজ্বলে চোখে ইশতিয়াক সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলল, “বাবা আমি যাই নিচে? পানিতে?”
ইশতিয়াক সাহেব অবাক হয়ে নীলার দিকে তাকিয়ে রইলেন। শাহনাজ মারা যাবার পর মেয়েটি একেবারে সবকিছুতে আকর্ষণ হারিয়ে ফেলেছিল, কত চেষ্টা করেও কোনকিছুতেই একটুকু আগ্রহ বা কৌতূহল জাগাতে পারেননি। দুই বছর পর এই প্রথমবার সে কিছু একটা করতে চাইছে। শুধু যে করতে চাইছে তাই নয়, সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে দিচ্ছে। তিনি নরম গলায় বললেন, “যেতে চাইলে যা মা। আমি আসব?”