“কী?”
“একটা সাহেবের মতো লোক–ঐ যে সাদা লঞ্চে করে যায় সে তোমাকে খুঁজছে।”
“আমাকে?” বকুল মনে করার চেষ্টা করতে থাকে কীভাবে সে সাদা লঞ্চের মানুষের সাথে একটা গোলমালে জড়িয়ে পড়ল।
বড়চাচি কাছে দাঁড়িয়েছিলেন, এবারে চোখ কপালে তুলে বললেন, “ও মা গো! কী ডাকাতে মেয়ে! লঞ্চওয়ালার সাথে গোলমাল করে এসেছে!”
বকুল তেজি ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, “আমি কিছুই করি নাই।”
“তা হলে কেন তোকে ডাকছে?”
“আমি কেমন করে বলব?”
শরিফ এবং অন্যেরা বকুলের হাত ধরে টানতে টানতে বলল, “চলো বকুলাপ্পু। চলো। তাড়াতাড়ি চলো!”
মা এবং বড়চাচি দুশ্চিন্তায় মুখ কালো করে বসে রইলেন এবং তার মাঝে বকুল বাচ্চাদের নিয়ে নদীর ঘাটের দিকে চলল। বকুল দূর থেকে দেখতে পেল লঞ্চের উপর পুতুলের মতো দেখতে মেয়েটা বসে আছে, তাঁকে দেখে মেয়েটা উঠে দাঁড়াল। মেয়েটার পাশে দাঁড়িয়ে আছে সাহেবদের মতো দেখতে একজন মানুষ, সেই মানুষটা বকুলকে দেখে লঞ্চ থেকে নেমে এসে বললেন, “তুমি হচ্ছ বিখ্যাত বকুলাপ্পু?”
বকুল হঠাৎ করে একটু লজ্জা পেয়ে যায়। মানুষটি বকুলের পিঠে হাত দিয়ে বললেন, “তুমি একদিন ঐ গাছ থেকে নদীর পানিতে ডাইভ দিয়েছিলে, সেটা দেখে আমার মেয়ে এত মুগ্ধ হয়েছে যে সে তোমার সাথে পরিচয় করতে এসেছে।”
বকুল অবাক হয়ে মানুষটির দিকে তাকাল, যে-কাজটিকে প্রত্যেকটি মানুষ একটা বড় ধরনের দুষ্টুমি হিসেবে ধরে নেয়, তার জন্যে বকুনি থেকে শুরু করে বড় ধরনের পিটুনি পর্যন্ত খেতে হয়, সেই কাজটি করেছে বলে তাকে দেখতে এসেছে একটি মেয়ে! আর মেয়েটি হ্যাঁনো তেনো কোন মেয়ে নয়–একেবারে সেই স্বপ্নজগতের একটা মেয়ে।
সাহেবদের মতো লম্বা-চওড়া ফরসা মানুষটা বকুলের দিকে খানিকটা ঝুঁকে পড়ে বললেন, “আমার মেয়েটি নিজেই নেমে আসত, কিন্তু আসলে তার শরীরটি ভালো নয়।”
বকুল ভুরু কুঁচকে বলল, “কী হয়েছে?”
ফরসা মানুষটি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “তার একটা অসুখ করেছে। একটা কঠিন অসুখ। খুব দুর্বল সেজন্যে।”
বকুল অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে একবার মানুষটির দিকে আরেকবার পুতুলের মতো মেয়েটিরে দিকে তাকাল। এরকম ফুলের মতো সুন্দর একটা মেয়ের কখনো কি অসুখ করতে পারে?
“তুমি আসবে একটু আমার সাথে? আমার মেয়ে তোমার সাথে পরিচয় করার জন্যে বসে আছে।”
বকুল মাথা নাড়ল। তারপর মানুষটার পিছুপিছু লঞ্চের উপর উঠল। অনেকদিন আগে একবার সে লঞ্চে করে সদরঘাট গিয়েছিল, কী ভয়ানক ভিড় ছিল সেই লঞ্চে, কী ঘিঞ্জি নোংরা একটা লঞ্চ! আর তার তুলনায় এটা একেবারে একটা ছবির মতো, সাদা ধবধবে করছে, দেখে মনে হয় এটি বুঝি সত্যিকারের লঞ্চ নয়, বুঝি একটা খেলনা।
সাহেবদের মতো লম্বা-চওড়া ফরসা মানুষটি বকুলের হাতে ধরে সাবধানে উপরে নিতে নিতে বলল, “আমার নাম ইশতিয়াক আহমেদ, আর আমার মেয়ের নাম হচ্ছে নীলা।”
বকুল ভাবল সে একবার জিজ্ঞেস করবে নীলার কী অসুখ করেছে কিন্তু ততক্ষণে উপরে চলে এসেছে তাই আর জিজ্ঞেস করতে পারল না। ইশতিয়াক সাহেব নীলার কাছাকাছি গিয়ে বললেন, “নীলা, এই হচ্ছে বকুল, আর বকুল, এই হচ্ছে নীলা।”
বকুল কী বলবে বুঝতে পারল না, সে ছোট ছোট দুষ্টু ছেলেমেয়েদের নিয়ে যে-কোনরকম দুরন্তপনা করতে পারে, গলা ফাটিয়ে ঝগড়া করতে পারে, পাজি ছেলেদের ল্যাং মেরে ফেলে দিতে পারে–কিন্তু এরকম একটা ছবির মতে, সুন্দর লঞ্চের দোতলায় পুতুলের মতো একটা মেয়ের সামনে দাঁড়িয়ে কী কথা বলতে হবে সে বুঝতে পারল না। দুজন দুজনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল, তখন নীলা বলল, “আমি যে এরকম করে এসেছি তুমি কি রাগ হয়েছ?”
বকুল অবাক হয়ে বলল, “কেন রাগ হব কেন?”
“না, আমি ভাবলাম কোনোরকম খবর না দিয়ে অচেনা একজন মানুষ হঠাৎ করে—”
“আমি তোমাকে চিনি।”
নীলা অবাক হয়ে বলল, “তুমি আমাকে চেন?”
“হ্যাঁ। আমি তোমাকে অনেকবার দেখেছি তুমি এই লঞ্চে করে যাচ্ছ।”
“আমিও তোমাকে দেখেছি ঐ গাছের উপর থেকে তুমি ডাইভ দিচ্ছ। ইশ! তোমার ভয় করে না?”
বকুল ফিক করে হেসে বলল, “একটু একটু করে।”
নদীর ঘাটে ততক্ষণে অনেক বাচ্চার ভিড় জমে গেছে, সবাই লঞ্চে ওঠার জন্যে উসখুস করছে কিন্তু সাহস পাচ্ছে না। ইশতিয়াক সাহেব রেলিং ধরে দাঁড়িয়েছিলেন, তিনি তাদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা কি আসতে চাও?”
তার কথা শেষ হবার আগেই ডজনখানেক বাচ্চা হুড়মুড় করে লঞ্চের দিকে ছুটে যেতে থাকে, ধাক্কাধাক্কি করে কে কার আগে যাবে সেটা নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু হয়, উপর থেকে কোন-একজন নিচে পড়ে যাবে সেই ভয়ে ইশতিয়াক সাহেব চোখ বন্ধ করে ফেললেন। কয়েক সেকেন্ড পরে চোখ খুলে দেখলেন বকুল আর নীলাকে ঘিরে সব বাচ্চা দাঁড়িয়ে আছে–কেউ পড়ে যায়নি! বকুল আর নীলা কী নিয়ে কথা বলে সেটা শোনার জন্যে তারা একটা নিঃশব্দ কৌতূহল নিয়ে তাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে।
বকুল জিজ্ঞেস করল, “তোমার নাকি অসুখ করেছে?”
নীলা মাথা নাড়ল।
বকুল মাথা নেড়ে সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গি করে বলল, “কোন চিন্তা কোরো না। সবারই কোন-না-কোন অসুখ হয়।”
বকুল এবং নীলাকে ঘিরে যে বিশাল দর্শকমণ্ডলী দাঁড়িয়েছিল তারা সম্মতির ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল, আজিজ বলল, “আমার গত সপ্তাহে জ্বর হয়েছিল।”