“রোজ স্বপ্নে দেখি। রোজ।”
“কী দেখিস?”
“আমার সাথে রোজ রাতে কথা বলে আম্মু। আমাকে নিয়ে কোথায় কোথায় যাবে সেইসব বলে। আমার জন্যে আম্মু অপেক্ষা করছে।”
ইশতিয়াক সাহেব একটা নিঃশ্বাস ফেলে কথাটা ঘোরানোর জন্যে বললেন, “তুই কোথাও যেতে চাস মা?”
“না আব্বু, যেতে চাই না।”
“কিছু কিনবি? কোনো বই? ভিডিও-সিডি?”
“না আব্বু। কিছু লাগবে না।”
“কারও সাথে দেখা করবি? কথা বলবি? তোর কোন বন্ধুকে ডাকব?”
“না-না-আব্বু, কাউকে ডেকো না। আমার ভালো লাগে না।”
ইশতিয়াক সাহেব আবার খানিকক্ষণ চুপ করে বসে থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “দুপুরবেলা তোর আজমল চাচা আসবে।”
“ঠিক আছে।”
“তোর শরীর কেমন লাগছে তার সবকিছু বলিস আজমল চাচাকে।”
“বলব।”
“অমি একটু অফিসে থেকে ঘুরে আসি, কিছু লাগলেই ফোন করে দিবি।”
“দেব আব্বু।”
ইশতিয়াক সাহেব দরজা খুলে বের হয়ে যাচ্ছিলেন তখন হঠাৎ নীলা বলল, “আব্বু–”
“কী মা?”
“তোমার মনে আছে আমরা একদিন লঞ্চে করে যাচ্ছিলাম?”
“হ্যাঁ মা।”
“একটা মেয়ে–মনে আছে–একটা গাছের উপর থেকে পানিতে ডাইভ দিয়েছিল?”
“হ্যাঁ মা, মনে আছে।”
“মেয়েটা কী সুন্দর ছিল না, আব্বু? কী গ্রেসফুল! কী এনার্জেটিক!”
নীলা আরও কিছু বলবে ভেবে ইশতিয়াক সাহেব চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন, কিন্তু নীলা আরকিছু বলল না। তিনি মাথা নেড়ে বললেন, “হ্যাঁ মা, নিশ্চয়ই সুন্দর ছিল মেয়েটা। আমি তো দেখিনি, কিন্তু তুই তো দেখেছিস। তুই যখন বলছিস নিশ্চয়ই ছিল।”
ইশতিয়াক সাহেব ঘর থেকে বের হয়ে যেতে যেতে কী মনে করে আবার ফিরে এসে বললেন, “তুই মেয়েটার সাথে দেখা করবি মা?”
“আমি? দেখা করব?”
“হ্যাঁ। করবি?”
নীলা হঠাৎ কেমন যেন একটু লজ্জা পেয়ে গেল, বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, “করব? দেখা করে কী বলব তাকে?”
“যেটা ইচ্ছে হয় বলবি!”
“আমাকে দেখে কি হাসবে?”
“কেন? হাসবে কেন?”
“এই যে আমার এত অসুখ। গায়ে জোর নেই।”
“ধুর! সেজন্যে কেউ হাসে নাকি? মানুষের কি অসুখ হয় না? আর ভালো করে একটু খাবি তা হলেই তো জোর হবে।”
“তা হলে তুমি কী বল বাবা? আমরা কি যাব?”
“চল যাই। আমি ফোন করে দিচ্ছি, এখনই রওনা দেব।”
“তোমার অফিস?”
“আরেকদিন যাব অফিসে।”
.
চন্দ্রা নদীর তীরে পলাশপুর গ্রামের বাচ্চাকাচ্চারা হিজল গাছের নিচে লাফ-ঝাঁপ দিচ্ছিল, হঠাৎ তারা দেখতে পেল রাজহাঁসের মতো দেখতে অপূর্ব একটা লঞ্চ প্রায় নিঃশব্দে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। প্রথমে দেখতে পেল সিরাজ, সে অন্যদের দেখতেই সবাই খেলা বন্ধ করে লঞ্চটার দিকে তাকিয়ে রইল। সবাই ভেবেছিল লঞ্চটা কাছাকাছি এসে ঘুরে যাবে, কিন্তু সেটা ঘুরে গেল না, সত্যি সত্যি তাদের দিকে আসতে শুরু করল। লঞ্চের সামনে একজন মানুষ বাঁশ দিয়ে নদীর পানি আন্দাজ করছে। তীরের কাছাকাছি এসে মানুষটা লঞ্চ থেকে নেমে সেটাকে দড়ি দিয়ে একটা গাছের গুঁড়ির সাথে বেঁধে ফেলল, তখন সবাই লক্ষ করল উপরে রেলিঙের কাছে সাহেবদের চেহারার মতো একজন মানুষ এবং তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে একেবারে পুতুলের মতো দেখতে একটা মেয়ে। মানুষটার মাথায় চোখে যেন রোদ না লাগে সেরকম বারান্দাওয়ালা একটা টুপি। মানুষটা ইশতিয়াক সাহেব। তিনি উপর থেকে বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে হাসিহাসি মুখে বললেন, “তোমরা এখানকার?” বাচ্চাদের কারও কথা বলার সাহস হল না। এক-দুইজন ভয়ে মাথা নাড়ল।
ইশতিয়াক সাহেব আবার বললেন, “আমরা এখানে একজনকে খুঁজতে এসেছি। একটা মেয়ে, খুব সাহসী মেয়ে! এই যে গাছটা আছে সেটার একেবারে উপর থেকে নদীতে ডাইভ দিতে পারে।”
সাহেবদের মতো দেখতে ফরসা মানুষটি কার কথা বলছে বুঝতে বাচ্চাদের কারও একটুকু দেরি হল না। তারা প্রায় সমস্বরে চিৎকার করে বলল, “বকুলাপ্পু।”
“কী নাম বললে? ব-ব-”
“বকুলাপ্পু।”
“বকু-লাপ্পু?”
“হ্যাঁ। সিরাজ এবার সাহস করে কথা বলার দায়িত্বটুকু নিয়ে নিল। বলল, “তার নাম হল বকুল। আমরা সবাই বকুল আপু ডাকি।”
“ও!” ইশতিয়াক সাহেব হা হা করে হেসে বললেন, “বকুল আপু থেকে বকুলাপ্পু!”
ব্যাপারটা সাহেবের মতো চেহরার মানুষটাকে বোঝাতে পেরেছে সেই আনন্দে সিরাজ চোখ ছোট ছোট করে হেসে ফেলল। সে শরিফকে টেনে সামনে এনে বলল, “এই যে শরিফ। বকুলাপ্পুর ছোট ভাই।”
“ও! তুমি বকুলাপ্পুর ছোট ভাই!” ইশতিয়াক সাহেব হেসে বললেন, “আমরা তোমার বোনের সাথে দেখা করতে এসেছি।”
শরিফ পাংশুমুখে বলল, “কী করেছে বকুলাপ্পু?”
“কিছু করেনি! আমরা এমনি দেখতে এসেছি। কোথায় আছে বলবে?”
সিরাজ বলল, “ডেকে নিয়ে আসি?”
সিরাজের কথা শেষ হবার আগে শরিফ এবং আরও আট-দশজন বকুলকে ডাকার জন্যে গুলির মতো ছুটে গেল। তাদের গ্রামে এত বড় ব্যাপার এর আগে কবে ঘটেছে কেউ মনে করতে পারে না।
বাড়িতে তখন বকুলকে বকাবকি করা হচ্ছিল। রহমত চাচার পাগলি গাইটি কীভাবে জানি ছুটে গেছে, গ্রামের দুর্ধর্ষ মানুষেরা এই গাইয়ের ধারেকাছে যায় না, বকুল সেটাকে ধরার চেষ্টা করে পিছুপিছু ছুটে গিয়েছিল। গাইটি পথেঘাটে যত অনর্থ করেছে এখন তার সব দোষ এসে পড়েছে বকুলের ঘাড়ে। বকুলকে জন্ম। দিতে গিয়ে মা কেন মরে গেলেন না সেটা চতুর্থবারের মতো বলে মা পঞ্চমবারের মতো বলতে শুরু করেছিলেন তখন ছুটতে ছুটতে শরিফ এবং বাচ্চাকাচ্চার দল এসে হাজির। শরিফ হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “বকুলাপ্পু-সাংঘাতিক জিনিস হয়েছে।”