নোরার বাবা নাজমুল করিম সাহেব মুহিবকে দেখে চিন্তিত গলায় বললেন, এ-কী! তোমার কী অবস্থা! কতক্ষণ ধরে বৃষ্টিতে ভিজছ? দাড়াও দাঁড়াও, আমি টাওয়েল নিয়ে আসি। আগে মাথাটা মুছ। ইসকান্দর আমাকে বলেছে তুমি নোরার বন্ধু। তোমার সঙ্গে আলাপ-পরিচয় করব। তার আগে ভেজা কাপড় বদলাও। এক্কেবারে নতুন, ব্যবহার করা হয় নি এমন এক সেট কাপড় দিলে তোমার কি পরতে আপত্তি আছে?
মুহিবের খুব অদ্ভুত লাগছে। সে বসে আছে নোরার বাবার পাশে। তার গায়ে এই ভদ্রলোকের পায়জামা-পাঞ্জাবি। তাদের দুজনের হাতে চায়ের কাপ।
তোমার নাম মুহিব?
জি স্যার।
স্যার বলছ কেন?
মুহিব হকচকিয়ে গেল। আসলেই তো, সে স্যার কেন বলছে? ইন্টারভিউ দিয়ে দিয়ে অভ্যাস হয়ে গেছে বলেই কি স্যার বলছে? না-কি এই ভদ্রলোককে তাদের কলেজের কোনো স্যারের মতো লাগছে? একজনের সঙ্গে অবশ্যি মিল পাওয়া যাচ্ছে। আনন্দমোহন কলেজের ইতিহাসের স্যার, কুমুদ বাবু। ছাত্ররা সবাই তাকে ডাকত সেন্ট স্যার। উনি গায়ে সেন্ট না মেখে বাসা থেকে বের হতেন না। পোশাকে-আশাকে ফিটফাট বাবু। ভদ্রলোক হঠাৎ পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করতেন। কাউকে চিনতে পারতেন না, তবে ছাত্রদের দেখলেই চিনতেন। গল্প করার জন্যে খুব আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে যেতেন। মুহিবের সঙ্গে একদিন দেখা। তিনি হাসি হাসি মুখে এগিয়ে এলেন। কোমল গলায় বললেন, তোমার নাম মুহিব না?
মুহিব বলল, জি স্যার।
সেকেন্ড ইয়ার?
জি স্যার।
রোল থার্টি থ্রি?
জি স্যার।
দেখেছ, সব মনে আছে। পাগলদের কিছুই মনে থাকে না। আমার সবই মনে থাকে। ভালো আছ বাবা?
জি স্যার।
তুমি আমাকে এক শিশি সেন্ট কিনে দিতে পারবে? অন্য কোনো কিছুর অভাব বোধ করছি না। কাপড় ছাড়া ঘুরে বেড়াচ্ছি তাতেও তেমন অসুবিধা হচ্ছে না, তবে সেন্টের অভাবটা খুব বোধ করছি।
স্যার, আমি এক্ষুণি সেন্ট কিনে নিয়ে আসছি।
আমি তো সব সময় হাঁটাহাঁটির মধ্যে থাকি। আমাকে খুঁজে নাও পেতে পার। সেন্টটা কিনে তুমি আমার মার হাতে দিয়ে এসো। বাসা চিন তো? বকুল গাছওয়ালা বাড়ি।
জি স্যার বাসা চিনি।
মুহিব সেদিনই সেন্ট কিনেছিল। দামি সেন্টই কিনেছিল। কুমুদ স্যারকে সেই সেন্ট দেয়া হয় নি। কারণ স্যারের মা পুরনো বাসায় ছিলেন না। উনি কোথায় গিয়েছেন কেউ বলতেও পারল না। সেন্টটা মুহিবের কাছে এখনো আছে।
নোরার বাবা বললেন, কী চিন্তা করছ?
মুহিব চমকে উঠে বলল, কিছু চিন্তা করছি না।
তিনি হাসি হাসি মুখে বললেন, নোরা হঠাৎ করে বলল, ঝুম বৃষ্টির মধ্যে গাড়ি নিয়ে লং ড্রাইভে গেলে খুব নাকি মজা হবে। তুমি আমার মেয়ের বন্ধু, তার নেচার তো জানোই। যেই তার মাথায় চিন্তাটা এলো অমনি টেলিফোন করে বন্ধু-বান্ধব জোগাড় করল। মাইক্রোবাস নিয়ে বের হয়ে গেল। তোমাকে টেলিফোন করে নি?
জি-না।
তোমার হাতের ফুলগুলি দোলনচাপা না?
জি।
ইন্টারেস্টিং ব্যাপার কী জানো? আমি আমার মেয়ের নাম দোলনচাঁপা রাখতে চেয়েছিলাম। মেয়ের মা বলল, দোলনচাঁপা শুনলেই কবি নজরুলের বইয়ের কথা মনে হবে। সঙ্গে সঙ্গে চোখে ভাসবে কবির ঝাকড়া চুলভর্তি ছবি। আমি ডাকব আমার মেয়েকে, চোখে ভাসবে কবি নজরুলের ছবি— তা হবে না। শেষে ডিসিশান পাল্টে ইবসেনের চরিত্রের নামে নাম রাখলাম— নোরা। নোরা নামটা তোমার কেমন লাগে?
সুন্দর।
নোরা সুন্দর না-কি দোলনচাপা সুন্দর?
দোলনচাপা সুন্দর।
নোরার আরেকটা খাস বাঙালি নাম আছে। সেটা জানো? গানের ক্যাসেট বা সিড়ি যা বের হয় সেখানে তার বাংলা নামটা থাকে। জানো বাংলা নামটা?
জি, চন্দ্রাবতী।
চন্দ্রাবতী নামের অর্থ জানো?
জি-না।
চন্দ্রাবতী নামের অর্থ হলো চাঁদের সখী। নোরার একটা আরবি নামও আছে। আরবি নামটা আমার মা রেখেছিলেন— ওয়ামিয়া। এই নামের অর্থ হলো বৃষ্টি। মানুষের স্বভাবের উপর নামের প্রভাব পড়ে— এই কথাটা মনে হয় সত্যি। বৃষ্টি নাম রাখার জন্যেই বোধহয় বৃষ্টি হলেই আমার মেয়ের মাথা খারাপের মতো হয়ে যায়।
মুহিবের ঝিমুনি ধরে গেছে। নোরার বাবারও মনে হচ্ছে কথা বেশি বলার অভ্যাস। তিনি ক্রমাগতই কথা বলে যাচ্ছেন। এখন আর তার কথা মুহিব মন দিয়ে শুনছে না। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ঘর অন্ধকার। মুহিবের ধারণা কিছুক্ষণের মধ্যেই সে ঘুমিয়ে পড়বে।
মুহিব।
জি।
তুমি কর কী? পড়াশোনা?
পড়াশোনা শেষ করেছি। আমি বেকার।
ও আচ্ছা।
মুহিবের মনে হলো সে নিজে ঘুমের মধ্যে কথা বলছে। সে বেকার না। তার পকেটে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার আছে। ভিজে ন্যাতনাতে হয়ে গেছে। তাতে কী। সে কি ভুলটা শুদ্ধ করবে? বলবে যে এখন সে এরনস ইন্টারন্যাশনাল নামের মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে কাজ করে। থাক, দরকার কী।
মুহিব!
জি স্যার।
নোরার বন্ধুবান্ধদের আমি খুব পছন্দ করি। কেন জানো?
জি-না।
পছন্দ করি কারণ বেশির ভাগ সময় আমি দেশের বাইরে থাকি। নোরাকে ঘিরে একগাদা বন্ধুবান্ধব আছে— এটা ভেবে নিশ্চিত বোধ করি। আমি কী বলার চেষ্টা করছি বুঝতে পারছ?
জি পারছি।
তোমাদের বাসা কোথায়?
ঝিকাতলা।
নিজেদের বাড়ি?
আমার বড়চাচার বাড়ি। সবাই এক সঙ্গে থাকি।
ভালো তো। জয়েন্ট ফ্যামিলি উঠেই গেছে। বাবা-মা বেঁচে আছেন?
জি।
শুনতেই তো ভালো লাগছে। পিতা-মাতা-পুত্র-কন্যা সব এক ছাদের নিচে।
মুহিব ঘুম ঘুম গলায় বলল, বাবা আমাদের সঙ্গে থাকেন না। আলাদা থাকেন।