মুহিব ম্যানেজার সাহেবের ঘরে বসে আছে। এই ঘরের বড় বড় জানালা খোলা। পর্দা এক পাশে টেনে দেয়া। দোতলার এই ঘর থেকে আকাশ দেখা যাচ্ছে। রাস্তাঘাট দেখা যাচ্ছে। মুহিব জানালা থেকে চোখ ফেরাতে পারছে না। মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। তার উচিত অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারের কথা ভুলে গিয়ে রাস্তায় নেমে পড়া। ভিজতে ভিজতে নোরাদের বাড়িতে চলে যাওয়া। কিছু কিছু বৃষ্টি আছে দেখলেই ভিজতে ইচ্ছা করে। এখন সেই ধরনের বৃষ্টি হচ্ছে। অথচ তাকে ম্যানেজার সাহেবের ঘরে বসে থাকতে হচ্ছে। তার সময় কাটছে না। ম্যানেজার ভদ্রলোক স্বল্পভাষী। একবার শুধু বললেন, আপনি কবে জয়েন করবেন?
মুহিব বলল, জানি না।
ব্যস এই পর্যন্তই কথা। ম্যানেজার একজন বেয়ারাকে চোখের ইশারায় কী যেন বলল। সে মুহিবকে এক কাপ চা দিয়ে গেল। চা-টা খেতে ভালো। সুন্দর গন্ধ। এরকম চা পরপর দুকাপ খেতে হয়। কিন্তু দ্বিতীয় কাপ চায়ের কথা তার বলতে ইচ্ছা করছে না। মুহিব ভেতরে ভেতরে টেনশন বোধ করছে। তার মনে হচ্ছে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার হাতে পেতে পেতে বৃষ্টি থেমে যাবে। আকাশে অবশ্যি ঘনকালো মেঘ এখনো আছে। যেভাবে বৃষ্টি পড়ছে— আকাশের সব মেঘ ধুয়ে মুছে চলে যাবে। মুহিব চেয়ার ছেড়ে জানালার পাশে দাড়াল। আকাশের দক্ষিণ দিকটা নজর করে দেখতে হবে। দক্ষিণের সমুদ্র থেকে মেঘের সাপ্লাই যদি ঠিক থাকে তাহলে বৃষ্টি আরো ঘণ্টা দুই থাকবে।
রাতে দেখা স্বপ্নটা মনে পড়েছে। তার মানে দুপুর হয়ে গেছে। রাতের স্বপ্ন তার সব সময় দুপুরে কেন মনে পড়ে? ম্যানেজার সাহেবকে জিজ্ঞেস করে জেনে নেবে?
মুহিব সাহেব।
জি।
নিন— এইখানে সই করে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারটা নিন। কনগ্রাচুলেশন্স।
মুহিব অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার হাতে নিল। অতিদ্রুত চোখ বুলালো। অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। বেসিক পে দশ হাজার টাকা। হাউজরেন্ট, মেডিকেল অ্যালাউন্স সব মিলিয়ে পনেরো হাজার ছয়শ। প্রবেশনারি পিরিয়ড পার করলে রেগুলার পে-স্কেল শুরু হবে। রেগুলার পে-স্কেলটা কত? প্রবেশনারি পিরিয়ডটাই বা কত দিনের? মুহিব জানালা দিয়ে তাকাল। বৃষ্টি পড়া বন্ধ হয় নি। বরং বৃষ্টির জোর আরো বেড়েছে। মনে হচ্ছে পুরো ঢাকা শহর আজ বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে যাবে।
নোরাদের বাড়ির গেটের দারোয়ানের নাম ইসকান্দর। নোরা এই নাম সংক্ষেপ করে নিয়েছে। সে ডাকে ইস। ইসকান্দর থেকে ইস, কান্দর বাদ। নোরা যখন বলে, ইস ভাই, ছুটে চলে যান। খুব ঠাণ্ডা দেখে এক বোতল স্পাইট নিয়ে আসুন। গেট খোলা থাকুক। পাঁচ মিনিটের বেশি তো আপনার লাগবে না। এই পাঁচ মিনিটে ভয়ঙ্কর কিছু ঘটার সম্ভাবনা কম। ইস ভাই নিতান্তই অনিচ্ছার সঙ্গে যায়। ইস ভাইয়ের বয়স ষাটের কাছাকাছি। দীর্ঘ ত্রিশ বছর সে নোরাদের বাড়ির গেটের পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাটিয়েছে। গেট থেকে সামান্য দূরে গেলেই সে মনে হয় অস্থির বোধ করে। হয়তো নিজেকে সে গেটের অংশ বলেই এখন ভাবে।
তুমুল বৃষ্টির মধ্যেও ইসকান্দরকে দেখা গেল ছাতা মাথায় দিয়ে টুলের উপর বসে আছে। মুহিব গেটের ওপাশ থেকে আনন্দিত স্বরে বলল, ইস ভাইয়া, গেটটা খুলুন।
ইসকান্দর তাকাল। রাগী গলায় বলল, আমারে ইস ভাইয়া ডাকবেন না। আমার পিতামাতা আমার একটা নাম দিয়েছিল।
মুহিব বলল, সরি, আর ডাকব না। গেটটা খুলুন।
ইসকান্দর মুহিবের উপর থেকে মুখ ফিরিয়ে বলল, গেট খোলা যাবে না।
যাবে না কেন?
আপা বাড়িতে নাই।
মুহিব পরিষ্কার বুঝতে পারছে এটা একটা মিথ্যা কথা। ইস ভাইয়া ডাকায় দারোয়ান রেগে গেছে। দারোয়ানদের রাগের দৌড় গেট পর্যন্ত বলেই গেট খোলা হচ্ছে না। মুহিব বলল, ইসকান্দর শুনুন, আমি আপনার আপার কাছে এসেছি এটা আপনাকে কে বলল? আমি নোরার বাবার সঙ্গে কথা বলার জন্যে এসেছি। উনি কি বাসায় আছেন?
আছেন।
উনাকে খবর দিন।
মুহিবের ধারণা ছিল এই কথায় দারোয়ানের হুশ হবে। সে গেট খুলে দেবে। মিনমিনে গলায় বলবে, আপা বাসায় আছে। আমার ইয়াদ ছিল না। আসেন, ভিতরে আসেন। সে-রকম কিছু ঘটল না। দারোয়ান টুল ছেড়ে ভেতরের দিকে চলে গেল।
মুহিবের বুক ঈষৎ কেপে গেল। সত্যি কি নোরা বাড়িতে নেই? দারোয়ান কি নোরার বাবাকে খবর দিতে গিয়েছে? মুহিবের হাতে সাতটা দোলনচাপা। প্রবল বৃষ্টিতেও ধবধবে সাদা ফুলগুলির কিছু হয় নি। বরং সে নিজে চুপসে গেছে। ঠাণ্ডায় শরীর কাঁপছে। আয়নার সামনে দাঁড়ালে হয়তো দেখা যাবে ঠাণ্ডায় এবং বৃষ্টির পানিতে তার ঠোঁট নীলচে হয়ে গেছে। নোরার সিডি কেনা হয় নি। প্রধান কারণ টাকা ছিল না। সিডি না কেনায় ভালোই হয়েছে। এই বৃষ্টিতে সিডি বাঁচানোর কোনো উপায় থাকত না।
দারোয়ান ফিরে এসেছে। গেট খুলছে। তার চোখ-মুখ কঠিন হয়ে আছে। সে মুহিবের দিকে না তাকিয়েই বলল, আসেন। বড় সাহেব আপনাকে যেতে বলেছেন। মুহিব বলল, সে-কী!
নোরার বাবার সঙ্গে মুহিবের কখনো দেখা হয় নি। ভদ্রলোকের এমন অবস্থা যে বারো মাসের ভেতর তের মাসই থাকেন দেশের বাইরে। বার হাত কাঁকুড়ের তের হাত বিচির মতো অবস্থা। মাঝে মাঝে মেয়েকে ছবি পাঠান। ছবির পিছনে ছবি সম্পর্কে বর্ণনা থাকে। মুহিব এই ভদ্রলোককে প্রথম দেখে এরকম একটা ছবিতে। লম্বা ফর্সা এবং মাথাভর্তি আইনস্টাইনের মতো ঝাঁকড়া চুলের এক ভদ্রলোক কালো রঙের একটা পাথর হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। পাথরের দিকে তাকিয়ে আছেন মুগ্ধ দৃষ্টিতে। যেন এটা কোনো কালো পাথর না— এটা তাজমহল। বনসাই করে ছোট করা হয়েছে। ছবির উল্টা পিঠে ইংরেজিতে লেখা–মা নোরা, যে পাথর হাতে আমি দাঁড়িয়ে আছি এটা কোনো সাধারণ পাথর না। এটা একটা meteorite. অতি দূর কোনো নক্ষত্রপুঞ্জ থেকে এটা পৃথিবীতে এসে পৌঁছেছে। ভালো থেকো…