আবারো হাসি শুরু হলো।
এইখানেই তার ইন্টারভিউর সমাপ্তি। বলা যেতে পারে হাস্যকর সমাপ্তি। এ ধরনের ইন্টারভিউর পর আবারো তাকে কেন ডাকা হলো সে জানে না। জানার দরকারও নেই। তার জীবনটা একটা রুটিনের ভিতর পড়ে গেছে। এই রুটিনে মাঝে মধ্যে তাকে ইন্টারভিউ দিতে হবে। সে দিয়ে যাচ্ছে। ব্যস।
মাঝারি ধরনের ঠাণ্ডা ঘরে মুহিব বসে আছে। ঘরে এসি চলছে। দরজা-জানালা সবই বন্ধ। মুহিব ছোটখাট এক ভদ্রলোকের সামনে বসে আছে। ভদ্রলোকের বয়স পঞ্চাশের উপরে বলে মনে হচ্ছে। কত উপরে তা ধরা যাচ্ছে না। ভদ্রলোকের চেহারা শান্ত। তাকানোর ভঙ্গি শান্ত। কিছু কিছু মানুষ আছে প্রবল বড়-ঝঞার সময়ও যাদের দেখে মনে হয় বেশ শান্তিতে আছেন। ভদ্রলোক ঐ টাইপের। তিনিই সম্ভবত মুহিবের ইন্টারভিউ নেবেন। এই ভদ্রলোক কি প্রথম ইন্টারভিউ-র সময় ছিলেন? মুহিব মনে করতে পারছে না। মনে হয় ছিলেন না। থাকলে চেহারা মনে থাকত। ভদ্রলোক একাই মনে হয় ইন্টারভিউ নেবেন। প্রথম প্রশণটা কী হবে—আপনার নাম? বেশির ভাগ সময়ই এই প্রশ্ন দিয়ে শুরু হয়। দ্বিতীয় প্রশ্ন— এই নামের অর্থ কী? নামের অর্থ শুনে তিনি হাসাহাসি শুরু করবেন না তো? এইবার নামের অর্থ জিজ্ঞেস করলে ভুল অর্থ বলতে হবে। নামের অর্থ প্রেমিক না বলে সে বলবে সন্দেহকারী।
মুহিবের সামনের ভদ্রলোক রিভলভিং চেয়ারে বসে আছেন। যারা রিভলভিং চেয়ারে বসে তারা সারাক্ষণই চেয়ার নিয়ে কিছু নড়াচড়া করে। এই ভদ্রলোক তা করছেন না। প্রশ্ন করবার সময় হয়তো করবেন। মুহিব প্রথম প্রশ্নের জন্যে অপেক্ষা করছে। ঘরটা বেশি ঠাণ্ডা। তার রীতিমতো শীত করছে। হয়তোবা বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। বাইরের আবহাওয়া ঠাণ্ডা হয়ে গেলে এসি বসানো ঘর বরফ শীতল হয়ে যায়। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে কি-না জানতে পারলে ভালো হতো। ঝুম বৃষ্টি হলে যেতে হবে নোরার কাছে। মুহিবের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে ইন্টারভিউ শেষ করে ঘর থেকে বের হয়েই সে দেখবে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছে। রাস্তায় হাঁটু পানি। যদি সে-রকম হয় সে যে কাজটা করবে তা হলো— রিকশা নিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে চলে যাবে। সেখানে কদম ফুল বিক্রি হয়। নোরার জন্যে কিছু কদম ফুল কিনতে হবে। সিড়ি কিনতে হবে। সিডির নাম উড়ালপখি। উড়ালপখি মানে কী? যেই পাখি উড়ছে সেই পাখি? তাহলে বসে আছে যে পাখি তারে কী বলা হবে? বসালপঙ্খি? মাই গড, মস্ত একটা ভুল হয়ে গেছে তোমার জন্যে ডিভিডি ভাড়া করে আনা হয় নি। আজ রাতে বাসায় ফিরতে তার দেরি হবে। মা ছটফট করতে থাকবে ছবির জন্যে। ছবির নাম কয়লা।
আপনার চোখে কী হয়েছে?
মুহিব অন্য কিছু ভাবছিল বলেই হয়তো প্রশ্ন শুনে চমকে গেল। তার বুক ধড়ফড় করে উঠল। মনে হলো প্রশ্নটা খুবই কঠিন। এত কঠিন প্রশ্নের উত্তর সে দিতে পারবে না। তার চোখ যে ফুলে বন্ধ হয়ে আছে এটাও তার মনে ছিল না।
মুহিব হড়বড় করে বলল, স্যার, চোখে কী হয়েছে আমি জানি না। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি এই অবস্থা।
চোখ উঠে নি তো?
বুঝতে পারছি না স্যার।
ভদ্রলোক রিভলভিং চেয়ার সামান্য ঘুরালেন। শান্ত গলায় বললেন—১৯৭১ সনে সারা বাংলাদেশে চোখ উঠা রোগ হয়েছিল। এমন কোনো মানুষ ছিল না যার এই রোগ হয় নি। রোগটার নাম দেয়া হয়েছিল ‘জয় বাংলা’ রোগ। এমন প্রায়ই হয়েছে এই রোগে আক্রান্ত পাকিস্তানি মিলিটারিও চোখ লাল করে তাকিয়ে আছে, আবার যে মুক্তিযোদ্ধাকে সে গুলি করে মারার জন্যে ধরে নিয়ে এসেছে সেও চোখ লাল করে মিলিটারির দিকে তাকিয়ে আছে।
মুহিব চুপ করে আছে। এই গল্পটা শুনে তার কী রি-অ্যাকশন হওয়া উচিত সে বুঝতে পারছে না। সে কি হাসবে? এটা কি হাসির গল্প? মুহিব বলল— স্যার, আমার জন্ম ১৯৭১-এর পরে।
সেটা জানি, জন্ম তারিখ অ্যাপ্লিকেশন ফরমে লেখা আছে। আমি আপনার ফাইল পড়ে দেখলাম। Extracuriculam activitis-এর কলামে আপনি লিখেছেন— আমার কোনো প্রতিভা নেই। আমি প্রতিভাশূন্য মানুষ। আপনার কি সত্যই ধারণা আপনার কোনো প্রতিভা নেই?
জি স্যার। আমার নিজের এবং আমার বন্ধুবান্ধবদের আমার সম্পর্কে এই ধারণা।
একজন প্রতিভাশূন্য মানুষকে আমরা চাকরি দেব কী জন্যে?
চাকরি করার জন্য প্রতিভার দরকার হয় না স্যার।
কীসের দরকার হয়?
বুদ্ধির দরকার। আমার বুদ্ধি আছে। আমি পরিশ্রম করতে পারি।
বুদ্ধি আছে?
জি স্যার আছে।
আমরা দুজনকে রিক্রুট করেছি। একজন ছেলে একজন মেয়ে। আপনি দুজনের মধ্যে একজন। কী কারণে আপনাকে রিক্রুট করা হয়েছে সেটা অনুমান করে বলুন। দেখি আপনার বুদ্ধি আছে কি-না।
মুহিব সহজ ভঙ্গিতে বলল, আমাকে চাকরি দেবার আলাদা কোনো কারণ নেই। আমার ধারণা আমাকে আপনারা নিয়েছেন কারণ আমার চেহারা সুন্দর।
আপনার ধারণা ঠিক আছে। আপনার বুদ্ধি ভালো। অফিসে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন। অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার হাতে হাতে নিয়ে যান। আগামী মাসের এক তারিখে চাকরিতে জয়েন করতে পারেন। Welcome to the Aarons.
ভদ্রলোক হ্যান্ডশেক করার জন্যে হাত বাড়িয়েছেন। মুহিবের ইচ্ছে করছে হেন্ডশেক না করে ভদ্রলোকের পা ছুঁয়ে সালাম করতে। সবচে ভালো হয় সে যদি কার্পেটের উপর হামাগুড়ি দিয়ে ভদ্রলোকের দিকে এগিয়ে যায়। ভদ্রলোকের পায়ে কিছুক্ষণ মুখও ঘষা যেতে পারে। কুকুররা মনিবের কাছে গেলে কোলে উঠার জন্যে এরকম করে।